পদ্মা সেতু হয়ে বাস চলাচলের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তৈরি হয়েছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। রাজধানী ঢাকা থেকে দক্ষিণবঙ্গমুখী জেলাগুলোতে বাস চলতে বাধা দিচ্ছেন সেখানকার পরিবহন নেতারা। পদ্মা সেতু দিয়ে যাতায়াতের জন্য নতুন বাস নামাতে শুরু হয়েছে চাঁদাবাজি।
গত রোববার চালু হওয়া পদ্মা সেতু হয়ে বাস চালানোর অনুমোদিত রুট ১৫টি। এর ১২টিই ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে। নতুন বাস নামানোর অনুমোদন এখনও দেওয়া হয়নি। ফলে বাস চালানোর চেষ্টা হচ্ছে যার যেমন ইচ্ছামতো। রাজধানীর গাবতলী টার্মিনাল থেকে দক্ষিণবঙ্গের জেলা অভিমুখে বাসের পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচলের অনুমতি নেই, পথও নেই। এগুলো সায়েদাবাদে স্থানান্তরের জায়গাও নেই।
আগের দিনের মতো গতকাল সোমবারও পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্ত থেকে ওপারের শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরের গাড়ির তীব্র সংকট ছিল। এতে যাত্রীরাও ভুগছেন বেশ। মাওয়া থেকে ছাড়া গাড়িগুলো ফরিদপুরের ভাঙ্গার পর যেতে দিচ্ছেন না সেখানকার পরিবহন নেতারা। তবে সংখ্যায় কম হলেও ঢাকা থেকে বরিশাল, খুলনার মতো দূরবর্তী গন্তব্যের বাস নির্বিঘ্নে চলছে।
বাধা দেওয়ার সত্যতা স্বীকার করে ভাঙ্গা উপজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আনিসুর রহমান সমকালকে বলেন, ঢাকার বাস উপজেলায় থেমে থেমে চললে স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে নতুন বাস নামাতে বিনিয়োগ করেছেন। ঢাকার বাস বরিশাল, খুলনা, সাতক্ষীরা বা দূরের জেলায় গেলে আমাদের আপত্তি নেই। পদ্মা সেতুর কাছের উপজেলা পর্যায়ে যাত্রী নিয়ে গেলে স্থানীয়দের বিনিয়োগের কী হবে?
পদ্মা সেতু চালুর প্রথম দিন থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিআরটিসি ঢাকা-শরীয়তপুর পথে বাস চালাচ্ছে। গত রোববার চলেছে দুটি বাস। আইন অনুযায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিআরটিসি বাসের রুট পারমিট লাগে না। গতকাল এসব বাস চলতে বাধা দেন শরীয়তপুরের পরিবহন নেতারা। ঢাকা থেকে বিআরটিসি বাস শরীয়তপুর পর্যন্ত যেতে পারেনি; ডামুড্যা থেকে ফিরে আসে।
বিআরটিসির মতিঝিল ডিপোর ব্যবস্থাপক মাসুদ তালুকদার সমকালকে বলেন, শরীয়তপুরের পরিবহন নেতারা চান না, বিআরটিসি বাস চলুক। দক্ষিণবঙ্গের সব পথে বাস চালু করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পরিবহন নেতাদের বাধার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
বিআরটিসি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, কে কোথায় কেন বাধা দিয়েছে, এগুলো বড় কথা নয়। মঙ্গলবার সকালে শরীয়তপুরের বিআরটিসির বাস ছাড়বে ঢাকা থেকে- এটাই চূড়ান্ত কথা।
শরীয়তপুর জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি ফারুক তালুকদার সমকালকে বলেন, ‘বিআরটিসি বাস পথে পথে যাত্রী তুলতে পারবে না। শরীয়তপুর থেকে ছাড়ার পর মাঝে যাত্রী তুললে স্থানীয় পরিবহন কী করবে? ২৫ বছর ধরে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পদ্মা সেতুর আশায় লোকসান দিয়ে ব্যবসা করছেন। পদ্মা সেতু হওয়ার পর হুড়মুড় করে ঢাকার কোম্পানির বাস ঢুকে গেছে। একেকটি কোম্পানি ২০ থেকে ৫০টি করে বাস নামাচ্ছে। তাহলে শরীয়তপুরের ২০০ বাস কোথায় যাত্রী পাবে? তারা কি ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে পদ্মা সেতুতে গিয়ে চটপটি বিক্রি করবে?’
ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জের পরিবহন নেতারা জানিয়েছেন, পদ্মার ওপারের জেলাগুলোর মালিক সমিতি চাঁদাবাজি শুরু করেছে। নতুন রুট চালুতে ৫ থেকে ২৩ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবি করছে। চাঁদা না দিলে বাস চলতে দেবে না। তবে অভিযোগকারী নেতারা ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কায় তাঁদের নাম বলেননি। তাঁরা সমকালকে বলেছেন, রাজনৈতিক নেতারাও এতে জড়িয়েছেন। একজন সাবেক মন্ত্রীর ভাইয়ের কাছেও চাঁদা চাওয়া হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিও চাঁদাবাজি শুরু করেছে রসিদ দিয়ে। এ জেলা হয়ে পদ্মা সেতুমুখী বাস থেকে ৬০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে মাওয়ায়। ফিরতি পথেও চাঁদা নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ মিলেছে। যদিও মালিক সমিতির সরকার অনুমোদিত দৈনিক চাঁদা ২০ টাকা।
তবে মুন্সীগঞ্জ জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বকুল খান সমকালকে বলেন, শ্রমিক ও মালিক সমিতির জন্য ৩০ টাকা করে মোট ৬০ টাকা নেওয়া হয়েছিল। রোববার মাত্র ৫০টি গাড়ি থেকে নেওয়ার পর আর তোলা যায়নি।
বকুল খান আরও জানান, গ্রিনলাইন, বিআরটিসিসহ যেসব বড় প্রতিষ্ঠানের বাস বরিশাল ও খুলনায় যাচ্ছে, সেগুলো বাধা দেওয়া হচ্ছে না। ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জের বাস চলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এ কারণেই যাত্রীরা ভুগছেন। মাওয়া থেকে ভাঙ্গা মাত্র ২৫ কিলোমিটারের ভাড়া ২০০ টাকা হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সমকালকে বলেছেন, রুটের জন্য চাঁদাবাজির অভিযোগ পাইনি। বিভিন্ন জেলার সমিতির অনুমোদিত হারের চেয়ে বেশি চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ এসেছে। যদি কোনো বাসের পথের মধ্যে জেলায় কাউন্টার থাকে, তবেই সমিতিকে সরকার অনুমোদিত হারে চাঁদা দেবে। মঙ্গলবার দক্ষিণবঙ্গের সব জেলাকে চিঠি দেওয়া হবে, কেউ যেন সরকার অনুমোদিত হারের বেশি চাঁদা আদায় না করে। অননুমোদিত চাঁদা নিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। মালিক সমিতি সহায়তা করবে।
আগে মাওয়া ঘাটে কোনো বাস ফেরিতে পার হতো না। ঢাকার গাড়ির যাত্রী শিমুলিয়ায় নামতেন। যাত্রীরা লঞ্চে বা ফেরিতে নদী পার হয়ে বাংলাবাজার, কাঁঠালবাড়ী ঘাট থেকে গন্তব্যের বাস ধরতেন। দক্ষিণ থেকে ঢাকামুখী যাত্রীদেরও এভাবে ভেঙে ভেঙে চলতে হতো। পদ্মা সেতুর কারণে সরাসরি বাস যোগাযোগ চালু হয়েছে।
পদ্মা সেতু হয়ে বাস চলতে শুধু স্থানীয় পর্যায়ে বাধা ও চাঁদাবাজি নয়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও রয়েছে। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এখনও নতুন রুট অনুমোদন দেয়নি। বিআরটিএর আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (আরটিসি) রুট পারমিটের অনুমোদন দেয়। সংস্থাটির চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, আবেদন পেলে পদ্মা সেতু হয়ে রুটকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে। তবে গাবতলীর গাড়িকে অনুমোদন দেওয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান।
সায়েদাবাদ থেকে গোপালগঞ্জ রুট থাকলেও এ পথে একটি বাসেরও রুট পারমিট নেই। সায়েদাবাদ থেকে শরীয়তপুরের বাস মাত্র ১৫টি। খুলনার বাস ৩১১টি। বিপরীতে গাবতলী থেকে কয়েক গুণ বাস চলে। গাবতলী থেকে পাটুরিয়া ঘাট হয়ে দক্ষিণবঙ্গের পথে চলা শ্যামলী এনআর পরিবহনের মালিক রাকেশ ঘোষ জানান, পদ্মা সেতুর সুফল তাঁরা পাচ্ছেন না। যত দিন না গাবতলী থেকে এক্সপ্রেসওয়ে পর্যন্ত ইনার সার্কুলার রুট বা হেমায়েতপুর থেকে এক্সপ্রেসওয়ে পর্যন্ত মিডল সার্কুলার রুট না হচ্ছে, তত দিন গাবতলীর লাভ নেই। গাবতলী থেকে বাস সায়েদাবাদে নিয়ে রাখার জায়গা নেই।
সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ১৫ জেলার বাস চলে। টার্মিনাল বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবদুস সোবহান বলেন, এসব বাসেরই জায়গা হয় না সায়েদাবাদে। নতুন বাস যোগ হলে কোথা থেকে ছাড়বে?