গতকাল ২৮ জুন স্থানীয় সময় রাত ৮টায় সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ম্যাগডালেনা অ্যান্ডারসনের স্টেট সেক্রেটারি অস্কার স্টেনস্ট্রোম নিশ্চিত করেছেন, তুরস্ক ন্যাটোতে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভেটো তুলে নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ম্যাগডালেনা অ্যান্ডারসন বলেন, সামগ্রিকভাবে সুইডেন এবং সুইডিশ জনগণের নিরাপত্তার জন্য একটি চুক্তি হয়েছে। আমরা আজ একটি দীর্ঘ বৈঠক করেছি; যেখানে সুইডেনের সন্ত্রাসবিরোধী আইনসহ আমাদের নেওয়া সমস্ত ব্যবস্থা সম্পর্কে তুলে ধরেছি। আমরা সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং তুরস্কের মধ্যে এমন একটি চুক্তিতে পৌঁছেছি, যা বর্তমান বিশ্বের অস্থির পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বাড়াবে।
প্রসঙ্গত, মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর নর্ডিক দুই প্রতিবেশীর কাছ থেকে ন্যাটোর আবেদন তুরস্ক গ্রহণ করেছে। তবে অন্যান্য ন্যাটো দেশগুলোর পার্লামেন্ট দ্বারা আবেদনটি অনুমোদন করা এখনো বাকি রয়েছে।
সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান লিন্ডের মতে, বৈঠকটি মূলত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গি ও লড়াইয়ের ব্যাপারে কঠিন আলাপ-আলোচনাকে সহজ ভাষায় বোধগম্য করেছে।
সুইডেনের দৈনিক এসভিডি-র প্রতিবেদক থেরেসি লারসন হাল্টিন বলেছেন, তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন এবং পরস্পরের সাথে করমর্দন করেছেন। তবে, স্বাক্ষর শেষে কোনো যৌথ সংবাদ সম্মেলন তাঁরা করেননি।
মাদ্রিদে তিন দেশীয় নেতারা সন্ত্রাসবাদ এবং অস্ত্র রপ্তানি সম্পর্কে তুরস্কের উদ্বেগের প্রতিক্রিয়া হিসাবে একটি যৌথ ত্রিপক্ষীয় নথি তৈরিতে কাজ করছেন। এই বৈঠকের আয়োজক ছিলেন ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ।
গতকাল মঙ্গলবার মাদ্রিদে প্রধানমন্ত্রী ম্যাগডালেনা অ্যান্ডারসন, ফিনিশ প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তো এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি ছিল নিষ্পত্তিমূলক।
ন্যাটোতে সুইডেনের যোগদানের পথ প্রশস্ত করেছে উল্লেখ করে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী মাগডালেনা আন্ডেরসন টুইট বার্তায় বলেন, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে সমঝোতামূলক মেমোরেন্ডাম সবেমাত্র সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং তুরস্কের মধ্যে পৌঁছেছে। তবে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আজ বুধবার আঙ্কারায় সুইডেনের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা চলবে।
ত্রিপক্ষীয় বৈঠক শেষে ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ সংবাদ সম্মেলনে তুরস্ক, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে যে সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা পড়ে শোনান। চুক্তিমূলক সমঝোতায় ছিল- ন্যাটোর সম্ভাব্য সদস্য হিসেবে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন তুরস্ককে তার জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির বিরুদ্ধে পূর্ণ সমর্থন প্রদান করবে। ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন তুরস্কের কুর্দি আন্দোলন এবং গুলেন আন্দোলন হিসেবে বর্ণিত সংগঠন দু’টিকে সমর্থন প্রদান করবে না।
স্টলটেনবার্গের ভাষ্য অনুযায়ী চুক্তিতে আরো উল্লেখ করা হয় যে, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন সন্ত্রাসবাদকে কঠোর ভাষায় প্রত্যাখ্যান ও নিন্দা করে তার স্বরূপ প্রকাশ করবে।
ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ জোর দিয়ে বলেছেন, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড সদস্য হিসেবে ইউরোপে ন্যাটোর অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবে।
সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের জন্য তাঁদের এপ্লিকেশনগুলো গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি ন্যাটোর জন্যও। মানচিত্রের দিকে তাকালে যে কেউ বুঝতে পারবে যে, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড বাল্টিক সাগর অঞ্চলের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি পরিবর্তন করবে এবং বিশ্বের এই অঞ্চলে ন্যাটোর উপস্থিতি আরো জোরদার করবে।
তুর্কির ইংরেজিভাষী সরকারী সংস্থা ডেইলি সাবাহ এই চুক্তির বিষয়ে আরও কিছু তথ্য প্রকাশ করে বলেছে, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন পিকেকে এবং অন্যান্য সব সন্ত্রাসী সংগঠনের কার্যকলাপ এবং তাদের বৃদ্ধি ছাড়াও এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির সাথে যুক্ত বা অনুপ্রাণিত গ্রুপ বা নেটওয়ার্কের ব্যক্তিদের কার্যকলাপ রোধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।
‘একটি চুক্তি কি প্রস্তুত?’- সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান লিন্ডে বলেন, অবশ্যই! এটিকে একটি ‘স্মারক’ বলা হয়, যেখানে সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা স্বাক্ষর করেছেন বলে তিনি নিশ্চিত করেন।
ফিনল্যান্ডের পক্ষে সেদেশের প্রেসিডেন্ট নিনিস্তো বলেছেন, তিনি এরদোয়ানের সাথে মঙ্গলবারের বৈঠক এবং এর ফলাফল সম্পর্কে আশাবাদী বা হতাশাবাদী ছিলেন না। তবে তিনি উল্লেখ করেছেন, এর আগের সপ্তাহে তুরস্কের সাথে আলোচনা জোরদার হয়েছিল। তাঁর মতে, মঙ্গলবারের আলোচনা আগের চেয়েও ভালো হয়েছে এবং উভয় পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া বেড়েছে।
গত সোমবার যখন সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যান্ডারসন এবং ন্যাটো মহাসচিব স্টলটেনবার্গ ব্রাসেলসে একটি প্রেস কনফারেন্স করেছিলেন, তখন তারা উভয়েই তুরস্কের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সেদেশের ‘নিরাপত্তা-ভীতি’ মোকাবেলায় সুইডেন কী করেছে এবং করছে, তা তুলে ধরতে সতর্ক ছিলেন।
বিশেষ করে সন্ত্রাস দমন, অস্ত্র রপ্তানি এবং সন্ত্রাসী প্রত্যর্পণ। স্টলটেনবার্গ সেদিন প্রধানমন্ত্রী অ্যান্ডারসনকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আপনি ইতোমধ্যে সুইডিশ আইন সংশোধন করেছেন। আপনি (সন্ত্রাসী কুর্দি দল) পিকেকে-এর বিরুদ্ধে পুলিশি তদন্ত শুরু করেছেন এবং আপনি বর্তমানে তুর্কি প্রত্যর্পণের অনুরোধগুলো খতিয়ে দেখছেন।
ব্রাসেলসে স্টলটেনবার্গ আরো বলেছেন, এই কংক্রিট ব্যবস্থার অর্থ, বিপজ্জনক এবং অপ্রত্যাশিত বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের প্রতি সুইডেনের মনোভাবের একটি দৃষ্টান্তমূলক আমূল পরিবর্তন।
সুইডেনের দৈনিক দাগেন্স নিহেতেরের তথ্য অনুসারে জানা যায়, সুইডেনের গোয়েন্দা সংস্থা ‘স্যাপো’-র কাছে পিকেকে-র সাথে যুক্ত সুইডেনের ‘অন্তত এক ডজন’ ব্যক্তির একটি তালিকা রয়েছে। তবে সুইডিশ নাগরিকত্ব প্রাপ্ত কাউকে প্রত্যার্পন করা হবে বলে আপাতত মনে করা হচ্ছে না।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলন শুরু করার সাথে সাথে আমরা চমৎকার একটি খবর পেলাম। সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড আমাদের দুর্দান্ত জোটকে আরও শক্তিশালী এবং আরও সুরক্ষিত করবে।