ক্ষুধায় ভুগছে শ্রীলঙ্কাবাসী। খাদ্যঘাটতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তাদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। লঙ্কাবাসীদের এখন কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, খাবার কেনার টাকা নেই। ঠিকমতো তারা খেতে পারছে না। একবেলা কোনো রকম খেয়ে আরেকবেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।
রাজধানী কলম্বোর কাছে স্লেভ দ্বীপের বাসিন্দা মিল্টন পেরেরা। তার বয়স ৭৪ বছর। ছয় সন্তান নিয়ে পেরেরার সংসার। ঠিকমতো খাবার না পেয়ে গালগুলো ডুবে গেছে এবং শরীরের হাড় ও শিরাও দেখা যাচ্ছে। বার্তাসংস্থা এএফপিকে তিনি জানিয়েছেন, একটি মাছ কেনারও টাকা হাতে নেই তার। মাছ খাওয়া তাদের জন্য এখন বিলাসিতা। মাছ রান্না হলেও তা সন্তানদের জন্য তুলে রাখা হয়। আর প্রাপ্তবয়স্কদের ভাগ্যে জোটে শুধু ঝোল।
পেরেরার ছেলে রজিতকুমার একজন বিদ্যুৎ শ্রমিক। কয়েক মাস ধরে তার হাতে কোনো কাজ নেই। তিনি বলেন, খাদ্যের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। এত দ্রুত যে খাবারের দাম বাড়তে বাড়ে আমি কখনো চিন্তাও করতে পারিনি।
পেরেরা ও তার পরিবার এখন পুরো শ্রীলঙ্কার প্রতিচ্ছবি। তাদের মতো অনেক মানুষই প্রয়োজনীয় খাদ্য কেনার সামর্থ্য হারিয়েছে।
বুদ্ধপূর্ণিমার দেশটিতে এখন একটি রুটির দামও অনেক চড়া। এক টুকরো রুটি কেনার সামর্থ্যও হারিয়েছেন অনেকে। দেশটিতে এখন দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দাম। বিবিসির তথ্যানুযায়ী, মাত্র এক কেজি আলুর দাম ৪৩০ শ্রীলঙ্কার রুপি। ডালের কেজি ৬২০ রুপি, চিনির কেজি ৩৪০ রুপি ও চালের দাম কেজিতে ২২০ রুপি। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্যভাবে দাম বেড়েছে মাছ, মরিচ, নারকেল তেল ও চায়ের।
শ্রীলঙ্কার সরকারি তথ্যমতে, এ বছর জুনে শ্রীলঙ্কায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮০ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছেছে।
দেশটিতে এক কেজি লাউয়ের জন্য স্লেভ দ্বীপের বাসিন্দাদের এখন ১ হাজার রুপি গুনতে হচ্ছে। সেখানকার একজন সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ ফয়সাল জানান, তিন মাসে আগের চেয়ে পণ্যের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। ক্রেতারা এখন খুবই অল্প পরিমাণে পণ্য কিনছেন। আগে যেখানে তারা কিলোগ্রামে কিনতেন, এখন তারা গ্রামে কিনছেন। তাদেরকে ১০০ গ্রাম, ৫০ গ্রাম করেও খাদ্যদ্রব্য কিনতে হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার খাদ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূলত জ্বালানি সংকট ও এর ফলে যথাযথ পরিবহন ব্যবস্থার সংকটই দায়ী।
এ অবস্থায় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যার ২২ শতাংশ অর্থাৎ ৫০ লাখ ৫০ হাজার মানুষের খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন। সর্বশেষ মূল্যায়নের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার প্রতি ছয়টি পরিবারের পাঁচটি খাদ্য সংকটে রয়েছে। দেশটিতে যতটা না খাদ্য ঘাটতি রয়েছে, তার চেয়ে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।
শ্রীলঙ্কার নিউ ম্যানিংয়ের বৃহৎ সবজি বাজারে মাইলের পর মাইল হেঁটে অনেক মানুষ বাজার করতে আসছেন। কারণ, তাদের পার্শ্ববর্তী বাজারের চেয়ে এ বাজারটিতে দাম একটু কম। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নষ্ট হওয়ায় বাজারটি থেকে অনেক অবিক্রীত ও নষ্ট সবজি ফেলে দেয়া হচ্ছে। বাজার বন্ধের পর সেখানে দরিদ্র মানুষের সবজি কুড়াতে দেখা গেছে।
দেশটির নজিরবিহীন এই সংকট এমনি এমনি তৈরি হয়নি। এ জন্য দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের ‘অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে’ দায়ী করা হয়েছে। কোভিড-১৯ সেই পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। গত চার মাস ধরে শ্রীলঙ্কা যে দুর্ভোগে পড়েছে তা থেকে উত্তরণ সহসাই মিলছে না।
আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কা: সিঙ্গাপুর থেকে সোমালিয়া
মার্কিন ডলার ও অন্যান্য প্রভাবশালী মুদ্রার বিপরীতে শ্রীলঙ্কার রুপির ব্যাপক অবমূল্যায়ন হয়েছে। বিপুল ঋণগ্রস্ত শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। এক বছরের মাথায় খাবারের দাম ৮০ শতাংশ বেড়েছে।
সংকট ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার বেলআউট সুবিধা চেয়েছে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা স্থবির আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মূলত রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে। পরিবেশ বিবেচনায় তারা হুট করে কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করেছিল। এই সিদ্ধান্ত কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করেও নেয়া হয়নি। এর ফলে খাদ্য উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের শিক্ষক ড. থিরুনি কালেগামা বলছেন, শ্রীলঙ্কার এত বড় অর্থনৈতিক সংকটের জন্য কেবল রাসায়নিক সারের ব্যবহার বন্ধ দায়ী নয়। কেবল এটিকে দায়ী করে হলে এই সংকটকে খুব ছোট করে দেখা হবে। এই অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া ও তার পরিবারের দীর্ঘদিনের ‘খেয়ালখুশি অর্থনৈতিক নীতি’ দায়ী।
কয়েক মাস ধরে চলা সংকটের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে এবং প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে তাদের পদ ছেড়েছেন। মাহিন্দার পর রনিল বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরও সংকট কাটছে না। বরং আরও তীব্র হয়েছে।