সরকারের মৎস্যবান্ধব বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৮৬ লাখ ২১ হাজার মেট্রিক টন, যা আগের বছরের চেয়ে ১ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন বেশি। ২০০৪-০৫ সালে দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ২২ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন।
এই হিসেবে বিগত ১৬ বছরের ব্যবধানে মাছের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২২’ উদযাপন উপলক্ষে শনিবার (২৩ জুলাই) মৎস্য ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।
শনিবার (২৩ জুলাই) থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২২’ উদযাপন করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মৎস্যখাত বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। দেশের মোট জিডিপি’র ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ, কৃষিজ জিডিপি’র ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং মোট রপ্তানি আয়ের ১ দশমিক ২৪ শতাংশ মৎস্যখাতের অবদান। দেশের প্রায় ২ কোটি জনগোষ্ঠী, যা মোট জনগোষ্ঠীর ১২ শতাংশের অধিক, মৎস্য সেক্টরের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত।
মন্ত্রী জানান, মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২২’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। সরকার পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়নের পাশাপাশি মৎস্য খাতেও ব্যাপক উন্নয়নের সূচনা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ইলিশ মাছ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও গৌরবের প্রতীক। দেশের মোট মাছ উৎপাদনের ১২ দশমিক ২২ ভাগ আসে ইলিশ থেকে। দেশের জিডিপিতে ১ শতাংশের বেশি অবদান রাখছে এই একটি মাছ। ইলিশ সম্পদের সুরক্ষা ও উন্নয়নে সরকার নানা সমন্বিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করায় ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জাটকা রক্ষায় নভেম্বর হতে জুন পর্যন্ত ৮ মাস জাটকা ধরা বন্ধ রাখা এবং ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন ইলিশ আহরণ বন্ধ রাখা, অবৈধ জাল নির্মূলে বিশেষ কম্বিং অপারেশন পরিচালনা, অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনা, জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং নদ-নদী, মৎস্য বাজার, মাছ ঘাট ও আড়তে মোবাইল কোর্ট ও অভিযান পরিচালনা সরকারের ইলিশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কার্যক্রমের অন্যতম উদাহরণ। এর সঙ্গে মাছ ধরা বন্ধকালে জেলেদের জন্য ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা দান ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ইলিশের স্থায়িত্বশীল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে ‘ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৫ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সম্প্রতি ‘বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি’ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন থেকে ইলিশের পাশাপাশি বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি নিজস্ব পরিচয়ে ও স্বকীয়তায় সারাবিশ্বে পরিচিতি লাভ করবে। জিআই সনদ প্রাপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের মাছের এ ব্র্যান্ডিং মৎস্য রপ্তানিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
মন্ত্রী জানান, সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সর্বোত্তম আহরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আরভি মীন সন্ধানী নামক মৎস্য গবেষণা ও জরিপ জাহাজের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে এ পর্যন্ত ৩৮টি সার্ভে ক্রুজ পরিচালনা করা হয়েছে। এছাড়াও সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মৎস্য আহরণের জন্য ‘গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মৎস্য আহরণে পাইলট প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য সামুদ্রিক মৎস্য আইন, ২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে।
সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুদ ও জীববৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরে ১ হাজার ৭৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এলাকাকে ‘সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ড মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার ‘নিঝুমদ্বীপ সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সামুদ্রিক মৎস্য আইনের আওতায় প্রতি বছর ২০ মে হতে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মোট ৬৫ দিন সমুদ্র ও উপকূলীয় জলায়তনে সকল নৌযান দিয়ে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে বঙ্গোপসাগরে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূ্র্ণ মাছের উৎপাদন ও বিলুপ্তপ্রায় মাছের মজুদ বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন মাছ নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ পাচ্ছে।
সরকার প্রকৃত জেলেদের শনাক্ত করে তাদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র বিতরণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় জাটকা সংরক্ষণে ৪ মাস পরিবার প্রতি মাসিক ৪০ কেজি এবং ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে ২২ দিনের জন্য পরিবার প্রতি ২০ কেজি হারে চাল দিচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের অনুদান দেওয়ার পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে।
এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৭৭ হাজার ৮২৬ জন মৎস্যচাষিকে প্রায় ৯৯ কোটি ৭০ লাখ ২৭ হাজার টাকা মোবাইলের মাধ্যমে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী জানান, দেশীয় মাছ সংরক্ষণে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ৩৬ প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজনন কৌশল ও চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। প্রথমবারের মতো ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দেশীয় মাছের লাইভ জিন ব্যাংক। এই জিন ব্যাংকে এখন পর্যন্ত ১০২ প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করা হয়েছে। বিপন্নপ্রায় মৎস্য প্রজাতি সংরক্ষণ, অবাধ প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ৪৯৪টি অভয়াশ্রম পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি দ্রুত বর্ধনশীল ও প্রায় ২০ শতাংশ অধিক উৎপাদনশীল উন্নত জাতের ‘বিএফআরআই-সুবর্ণ রুই’ উদ্ভাবন করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দাবস্থা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান সরকারের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ফলে সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৪ হাজার ৪২ দশমিক ৬৭ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ৫ হাজার ১৯১ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা আয় হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি।
মাছ যাতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয় সে বিষয়টিও সরকার অত্যন্ত গুরত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে জানান মন্ত্রী।