তুমি বন্ধু কালা পাখি আমি যেন কী… বসন্তকালে তোমায় বলতে পারিনি। সাদা সাদা কালা কালা, রঙ জমেছে সাদা কালা, হয়েছি আমি মন পাগলা বসন্তকালে…’ দেশীয় তাল-লয়ের এই গানটিতে এখন বুঁদ হয়ে আছে পুরো দেশ।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত এই গানটির গীতিকার ও সুরকার নারায়ণগঞ্জের হাশিম মাহমুদ। তিনি একই সঙ্গে সুরকার, গীতিকার, ছড়াকার, আবৃত্তিশিল্পী ও অভিনয়শিল্পী।
তবে মানসিকভাবে তিনি এখন আর আগের অবস্থায় নেই। কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলেন। ভুগছেন মানসিক সমস্যায়। তাকে দেখভাল করেন তার ছোট ভাই বেলাল আহমেদ (৪৫) ও বৃদ্ধা মা জমিলা আক্তার (৭৫)।
আবুল হাশিম ও জমিলা আক্তার দম্পতির সাত সন্তানের মধ্যে হাশিম মাহমুদ পঞ্চম। বর্তমানে মায়ের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন তল্লার সবুজবাগ এলাকায় থাকেন তিনি। নিজের ঘরে লেখালিখি আর গান নিয়ে মত্ত থাকেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে নিজের ও লালনের গান গেয়ে অন্যকে আকৃষ্ট করেন হাশিম মাহমুদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা চত্বরে জীবনের বড় একটা সময় কাটিয়েছেন হাশিম মাহমুদ। সেখানে তিনি হাশিম ভাই নামেই ব্যাপক পরিচিত।
সম্প্রতি মুক্তির অপেক্ষায় থাকা মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ সিনেমার ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এতে তার পরিচিতি আরও বেড়ে গেছে। তবে তিনি ওই গানটির মতো আরও অন্তত ৯০টি গান রচনা করেছেন। এখনো গানের গলা বেশ ভালো তার। লালনগীতি ও নিজের গান করেন কোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই। খালি গলায় তার গাওয়া গান মুগ্ধ করে সবাইকে।
হাশিম মাহমুদকে দেখভাল করা তার ছোট ভাই বেলাল আহমেদ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় বেশ জনপ্রিয় নাম হাশিম মাহমুদ। তিনি সব সময় গানের মধ্যে থাকতেই পছন্দ করেন। গানের মধ্যে থাকবেন, গানের মধ্যে বাঁচবেন- এ ধরনের মানুষ তিনি। তিনি বরাবরই নিজেকে আড়াল করে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অনেকেই নিজেকে হাইলাইট করতে চান, কিন্তু তিনি এতে বিশ্বাসী নন। নারায়ণগঞ্জের শাপলা নামে একটি সংগঠন থেকে তার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পদার্পণ। সেই থেকেই গান, ছড়া ও ছোট গল্প লেখা শুরু। সেই সময়ে দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় তার লেখা ছোট গল্প ‘বিলুর এই সব দিনরাত্রি’ প্রকাশিত হয়েছিল।
সাধারণত পড়াশোনা করে জাগতিক জীবনে তিনি বিশ্বাসী না। বাবা তাকে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি দিয়েছিলেন। তবে সেখানে তার মন টিকেনি বেশি দিন, ফিরেছেন সেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। ছায়ানট থেকে রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীতের ওপর পড়াশোনা করলেন। তৃতীয় বর্ষে গিয়ে তিনি আর তা চালিয়ে যাননি। তবে যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছেন কিছু একটা শেখার চেষ্টা করেছেন। বিএ অনার্স পরীক্ষা দেবে দেবে এমন অবস্থায় বাংলা একাডেমি থেকে ছড়ার বই বের করেন। বইটির নাম দেন ‘ধপাস’।
পরে ঢাকায় বৈরাগী নামে একটি গানের দল করেন। স্লোগান দেন ‘আমরা শেকড়ের সন্ধানে’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে প্রথম প্রোগ্রাম করেন। তখন ওই এলাকায় পিনপতন নীরবতা। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে হাশিম ভাইয়ের গান শুনলেন। এরপর আরও চার থেকে পাঁচটি গানের প্রোগ্রাম হলো, বেশ আলোড়ন তুলল গানের দল বৈরাগী।
বেলাল আহমেদ আরও বলেন, অনেক সাংবাদিক সম্প্রতি আসছেন তার সঙ্গে কথা বলছেন। কিন্তু এই মানুষটাকে সুস্থ করা দরকার এটা কেউ বলেন না, খুব কষ্ট লাগে। তার একটু বিশেষ যত্ন নেওয়া দরকার। তার এখনো দেশকে দেওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে। তিনি নিজের সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করেন। অন্যের থেকে ধার বা চুরি করে তিনি সমৃদ্ধ নন। রাষ্ট্রের কাছে চাওয়া- যদি শিল্পীদের জন্য কোনো জায়গা থাকে, যেখানে স্বল্প ব্যয়ে মানসম্মত চিকিৎসার ব্যবস্থা যেন হয়। আমি ভাই হিসেবে এতোটুকুই চাই।
তিনি বলেন, হাশিম ভাইয়ের গান বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে, কিন্তু তার কী হচ্ছে। হাশিমের ভাইয়ের গান খুব ফেমাস হলো, কিন্তু ব্যক্তি হাশিম? ব্যক্তি হাশিম কি না খেয়ে থাকবে? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে? চারুকলায় এখনো তার গানগুলো খালি গলায় গাইতে শুনি। তবে একটা সময় তিনি মারা যাবেন, যে মানুষটা গানগুলো সৃষ্টি করলেন তার যত্ন হলো না, তার গানের যত্ন হলো। আমি আসলে এমন শিল্পবোধে বিশ্বাসী না। তার চিকিৎসার দরকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি কেউ এগিয়ে আসে, তবে আমি ভাই হিসেবে খুব খুশি হব।