বুড়িমারি ও বাংলাবান্ধা হয়ে ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য প্রসার ঘটবে
পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু সেতু দেশের সড়ক যোগাযোগে এক নেটওয়ার্কে এনেছে। এর সুফল পেতে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের সড়ক নেটওয়ার্ক আরো অত্যাধুনিক করা হচ্ছে। এ মহাসড়ক আগামীতে উত্তরবঙ্গে শিল্প কারখানা প্রসারসহ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে। রংপুর থেকে বুড়িমারি ও বাংলাবান্ধা হয়ে ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য প্রসার ঘটবে।
উত্তরবঙ্গের যোগাযোগের দ্বার এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বদলে দেবে নতুন যোগাযোগের দিগন্ত। ১৯০ কিলোমিটারের মহাসড়কটি রূপ পাবে ফোর লেন এক্সপ্রেসওয়ের আদলে। সংযোজন করা হবে নানা ধরনের অবকাঠামো। এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের অবস্থান টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা ও রংপুর জেলা। এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে এবং ব্যবসা-বাণ্যিজ বৃদ্ধিসহ নিরাপদ ও দ্রæত সময়ে যোগাযোগ স্থাপনে প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় সরকার।
জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, এলেঙ্গা টু রংপুর ১৯০ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক মানের সড়ক হচ্ছে। চীন, ভারত, নেপালসহ অন্যান্য দেশ থেকে বড় বড় গাড়ি যাওয়া-আসাকালে রাস্তার পরিবেশও সেই মানের হতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো, বাজার এলাকায় লোকজন রাস্তার উপরে হাঁটাহাঁটি করেন। ছোট ছোট যানবাহন চলাচল করে। এতে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ কারণে নির্দিষ্ট কিছু স্থানে অবশ্যই ফ্লাইওভার দিতে হবে। এতে জনসাধারণের উপকার হবে। জনভোগান্তির যাতে অবসান হয় সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে।
চলমান প্রকল্পের ওপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকার এই নিবিড় পরিবীক্ষণ করছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের আওতায় সড়ক ও জনপথ অধিদফতর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের পরিচালক ড. ওয়ালিউর রহমান বলেছেন, প্রকল্পটি ২০১৪-১৫ সালে ডিজাইন করা। এখন চলছে ২০২২। আগের প্রকল্পে ফ্লাইওভার ধরা ছিল না। এখন ফ্লাইওভারের প্রস্তাব নতুন করে উপস্থাপন করা হবে। এমনকি ফ্লাইওভারও ছিল না। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হয়েছে। এতে সবার চোখ খুলে গেছে। তাই নতুন করে এলেঙ্গা-রংপুর ১৯০ কিলোমিটার ফোর লেন এক্সপ্রেসওয়ের আদলে তৈরি করব। টাঙ্গাইল থেকে রংপুর কোনো বাধা থাকবে না। প্রথমে জমি অধিগ্রহণ দেড় গুণ দেয়া হতো। এখন এটা বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। এসব কারণেই মূলত ব্যয় বেড়েছে।
জানা যায়, সাউথ এশিয়া সাব রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) সড়ক সংযোগ প্রকল্পের আওতায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহযোগিতায় এ কাজ বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সেপ্টেম্বর ২০১৬ থেকে আগস্ট ২০২১ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৬৬২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে দাঁড়ায় ডিসেম্বর ২০২৪ সাল নাগাদ। ২০২১-২২ অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) অনুযায়ী প্রকল্পের অনুক‚লে ব্যয় পরিকল্পনা ছিল ৩ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা। এডিপি বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা।
বরাদ্দের বিপরীতে এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত ব্যয় হয় ১ হাজার ৩১৪ কোটি বা ৫৬ দশমিক ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ শুধু এক অর্থবছরে ৪৩ দশমিক ৮১ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে। এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত বাস্তব অগ্রগতি ৪৫ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৩৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। তবে ৮ বছর আগের সেই পরিকল্পনা এখন আর থাকছে না। এখন ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের আদলে রূপ দেয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। এ জন্য আগের নকশা পরিবর্তন করা হয়। পাশাপাশি প্রকল্পের আওতায় নতুন নতুন অবকাঠামোও সংযোজন করা হয়েছে। নতুন করে যানবাহনের গতিবেগ ধরা হয়েছে ৮০ কিলোমিটার। এলেঙ্গা-রংপুর ১৯০ কিলোমিটার ফোর লেন এক্সপ্রেসওয়ের আদলে নির্মাণ হবে। বর্তমানে প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ৪৫ শতাংশ।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নানা ধরনের দুর্বল দিক ও ঝুঁকি তুলে ধরেছে সরকারের প্রকল্প তদারকি প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকালে বারবার নকশা পরিবর্তন এবং নকশায় নতুন অবকাঠামো সংযোজন করা হয়। ভ‚মি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে দীর্ঘসূত্রতা এবং ইউটিলিটি স্থাপনা স্থানান্তর সংক্রান্ত জটিলতা দেখা গেছে। এছাড়া ভ‚মিকম্প ও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে নির্মাণাধীন অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বগুড়া, গোবিন্দগঞ্জ ও রংপুর জেলার বেশ কিছু স্থানে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন হয়নি। প্রকল্প চলাকালে নির্মাণসামগ্রীর দামের ঊর্ধ্বগতি এবং নতুন শুরু হওয়া প্যাকেজসহ বেশ কিছু প্যাকেজের নির্মাণ কাজে ধীরগতি দেখা গেছে। ফলে বারবার মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ছে নির্মাণাধীন গুরুত্বপূর্ণ ফোর লেনটির।
সড়ক সংযোগ প্রকল্পে আরো অন্তত সাতটি ফ্লাইওভার স্থাপনের প্রস্তাব করা হচ্ছে। এগুলো এই মহাসড়কের বাজার এলাকায় নির্মাণ করা হবে। এগুলো হবে শেরপুর, মাঝিরা, দ্বিতীয় বাইপাস, বনানী, মাটিডালি, চান্দাইকোনো ও রংপুরে। ফ্লাইওভার হলে যানজট ও দুর্ঘটনা কমবে।
তবে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে রংপুরের মডার্ন মোড় পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার চার লেন সড়কে রয়েছে কিছু জটিলতা। কারণ হিসেবে অধিগ্রহণ জটিলতাই সামনে এসেছে। এ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে মাজার-মসজিদ অপসারণে। মসজিদ-মাজারের অনুক‚লে অধিগ্রহণের বা ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়া হয়েছে। তবে ঠিকাদার ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের এই কাজে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে যে সঙ্কটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা দ্রæত সমাধান না হলে ফোর লেন সড়কটির কার্যক্রমে বাধা আসবে। এতে বেড়ে যেতে পারে নির্মাণ খরচ।
শাজাহানপুরের গÐগ্রাম জামে মসজিদ, বগুড়া সদরের জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা একাডেমির জামে মসজিদ, নওদাপাড়া গরের বাড়ি জামে মসজিদ, ঠেঙ্গামারা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, বাঘোপাড়া হাট বায়তুন নূর মসজিদ। আর মাজার রয়েছে চারটি। কবরস্থান রয়েছে একটি। স্কুল ও কলেজ রয়েছে একটি। এগুলোর বেশিরভাগই কমিটি নিয়ে আদালতে মামলা চলমান। অপসারণ করা যায়নি এসব প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পের মুখপাত্র ও নির্বাহী প্রকৌশলী জয় প্রকাশ চৌধুরী জানান, এশিয়ান হাইওয়ে সাউথ এশিয়া সাব রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) ও বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক করিডোরে (বিসিআইএম) নতুন করে বাংলাদেশের আটটি মহাসড়ক যুক্ত হতে যাচ্ছে। এই সড়কগুলোর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৬০০ কিলোমিটার। ১৯০ কিলোমিটার সড়কটি এর একটি অংশ। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্য সহজ করতেও রুটটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে।