কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম: মুহররম হলো ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। মুহররম শব্দটি আরবি যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে মুহররম মাস পবিত্র হিসাবে গণ্য। মহররমের ১০ তারিখ বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন দিন, যাকে আশুরা বলা হয়ে থাকে। বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই মাস। পবিত্র কুরআন মাজীদে উল্লেখিত চার সম্মানিত মাসের অন্যতম আরবি মাস মুহররম। এটি অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ মাস। এটি এমন একটি মাস যে মাসে সে যুগেও সব ধরণের যুদ্ধবিগ্রহ করা থেকে মানুষ বিরত থাকতো। সম্মান করতো মুহররমকে। বলতে গেলে, সকল সম্প্রদায়ের কাছে মুহররম মাসের মর্যাদা ছিল অত্যন্ত উঁচু। মুসলমানদের জন্য এই মাস ইবাদত বন্দেগীর মাস।
এ মাসে বা আশুরার সময় রোজা রাখার ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘রমজানের পর আল্লাহর মাস মুহররমের রোজা হল সর্বশ্রেষ্ঠ’। (সহিহ মুসলিম)। এর মাঝে আশুরার রোজার ফযীলত আরো বেশি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বসহকারে রোজা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি’। -(সহিহ বুখারী)। রাসূল (সা.) আরো বলেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যেদিন আল্লাহ তা’আলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন’।-(জামে তিরমিযী)। রমজানের রোজা ফরয হওয়ার পূর্বে আশুরার রোজা মুসলমানদের রাখতে হতো। এমাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। মহান আল্লাহ পাক এইদিন তাঁর অনেক কুদরত প্রকাশ করেছেন। এর মাঝে অন্যতম, বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা ভেঙ্গে দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদের সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছেন।
মুসলমান জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সঙ্গেও মহররম তথা আশুরার সম্পর্ক রয়েছে। মূর্তি-পূজারী রাজা নমরুদ আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের কারণে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত করে। আল্লাহর নবীকে আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করতে চেয়েছিল রাজা নমরুদ। কিন্তু আল্লাহ পাক আশুরার ১০ তারিখে তাঁর প্রিয় নবী ও বান্দাকে রক্ষা করেন আগুন থেকে। রাজা নমরুদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। হজরত নূহ (আ.)-এর নবুয়তের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ১০ মহররমের স্মৃতি। এ তারিখে মহাপ্লাবন থেকে মুক্তি পায় হজরত নূহ (আ:) ও আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা মানুষেরা। নূহ (আ.)-এর কিস্তি এই পবিত্র দিনে মাটি স্পর্শ করে। মাটিতে মানুষ আবার আবাদ শুরু করার সুযোগ পায়। অন্যদিকে, হিজরী ৬১ সনের ১০ মুহররম ঐতিহাসিক কারবালার ময়দানে প্রিয়নবী (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন ইবনু আলী (রা.) স্বৈরাচার ও একনায়ক শাসক ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনীর হাতে মর্মান্তিকভাবে শহিদ হন। ইয়াজিদ ছিল একজন মুনাফিক ও অত্যাচারী শাসক। তার অন্যায় ও অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে ইমাম হোসাইন (রা.) কূফা অভিমুখে রওনা দেন। এ সময় ইয়াজিদের বিপুল সংখ্যক সৈন্য কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইনের কাফেলাকে অবরুদ্ধ করে। এক অসম এবং অন্যায় যুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর ৭২ জন সঙ্গী শহিদ হন। এত বিপুল রণসজ্জা দেখেও ইমাম হোসাইন (রা.) ভীত হননি, বরং অত্যাচারী ইয়াজিদের বিরুদ্ধে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেন। প্রাণ দেন শিশু, যুবক, বৃদ্ধসহ অনেকেই। এরপরও তিনি অন্যায়, অবিচার মেনে নেননি। এই ঘটনাটি যেমন হৃদয়বিদারক তেমনি অত্যাচারী ও স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রেরণা যোগায়। অন্যায় আর অবিচারের সাথে আপোষ না করার দৃঢ়তা শেখায়।
ঐতিহাসিক এই আশুরার দিনে ইমাম হোসাইন (রা.) এর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে চলমান কোন ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলী রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য।অতএব, ফযীলতের এ মাসে আমরা যেমন রোজা, নফল ইবাদতসহ বিভিন্ন নেক আমল করব তেমনি ইমাম হোসাইন (রা.) এর শাহাদাতের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্যায়, অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শপথ নেব। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা আমাদের জীবনে ধারণ করার সংকল্প নিতে হবে। আসুন, সত্য ও ন্যায়ের পথে জীবন গড়ে তুলে মহান আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন করি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র মুহররম মাস এবং আশুরার বরকতে আমাদেরকে সব ধরণের অকল্যাণ থেকে মুক্ত রাখুন। আমিন।