সাজ্জাদ হোসেন চিশতী: বৈশ্বিক মন্দা, ডলার সংকট, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, করোনা বা রিজার্ভ কম থাকা- যে কোনো কারণেই হোক না কেন বর্তমানে বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম, জীবনযাত্রা অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনেক কিছুই আর সাধারণ মানুষের নাগালে নেই। যে কারণগুলো বললাম এ জন্য আমরা যারা চাকরিজীবী তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। যেমন তেলের দাম যদি বাড়ে তাহলে মিল মালিক, দোকানদার, ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেন। তাদের স্টকে যে তেল থাকে সেই তেল তারা যখন হঠাৎ করে দাম বেড়ে যায় বেশি দামে বিক্রি করার সুযোগ পান। আমরা যদি জ্বালানি তেলের কথা বলি, অনেক পাম্প মালিক সম্প্রতি এভাবে এক রাতে কোটিপতি হয়ে গেছেন।
চালের দাম বাড়ছে মিল মালিকরা এভাবে লাভবান হচ্ছেন। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে, বাস মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, দোকানদাররা মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ডলারের দাম বাড়ছে মানি একচেঞ্জগুলো বাড়িয়ে দিচ্ছে। কারো সমস্যা হচ্ছে না, সমস্যা হচ্ছে চাকরিজীবীদের। কারণ আমাদের বেতন বাড়ছে না।
সরকার যদি প্রতিটি বেসরকারি কোম্পানিকে বলে দিত বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় আপনারা মুনাফা কম করে আপনার মুনাফা থেকে ছাড় দিয়ে ২০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি করে দেন কর্মচারীদের তাহলে আজ আমাদের নাভিশ্বাস উঠতো না। প্রতি বছর ইনক্রিমেন্ট হচ্ছে সরকারি চাকরিজীবীদের। নানান সুযোগ-সুবিধাও তারা পাচ্ছেন। কিন্তু সে তুলনায় বেসরকারি চাকরিজীবীরা বঞ্চিত। আমরা মানুষের কাছে হাত পাততে পারি না, আমরা চাইতে পারি না, পক্ষান্তরে সইতেও পারছি না। এখন প্রতিদিন যদি একটা লোক সকালবেলা বের হয়, সারাদিন পর বাসায় ঢোকার সময় তার পকেট খালি! আমার বাসা রামপুরা, রামপুরা থেকে আমার অফিস মিরপুর। মিরপুর থেকে যাওয়া-আসা আমি যদি সিএনজিতে করি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ভাড়া লাগে। দুপুরের খাওয়া, হাত খরচ সব মিলিয়ে ১৫০০ টাকা খরচ। আমি যদি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করি ড্রাইভারের বেতন ২০-২৫ হাজার টাকা। জ্বালানি তেল কমপক্ষে ৫০০ টাকা। বছর বছর ট্যাক্স ফিটনেস ৪০ হাজার টাকা। মেনটেনেন্স মিলে একটা গাড়ির প্রতিদিনের খরচ দাঁড়ায় পনেরশো থেকে দুই হাজার টাকা। তাহলে আমরা কোথায় যাবো? কীভাবে চলবো?
বেসরকারি চাকরিজীবীদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। তারা বোবা কান্না করছে। বাজারে গেলে কিছু কেনা যাচ্ছে না। শুক্রবার ১২ আগস্ট ফার্মের মুরগির কেজি ২০০ টাকা, ডিমের ডজন ১৫৬ টাকা, চাল ৭৫ টাকা কেজি, ১৮০ টাকা কাঁচা মরিচের কেজি। আমরা কী খাবো? কী করবো? ২৮০ টাকা ৩০০ টাকা লাল বয়লার মুরগি- ভয়ঙ্কর অবস্থা! আমরা সরকারকে বলছি না যে, আমাদের রেশনিং দেন, যেটা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে আছে। আমরা আমাদের ঘরে ঘরে টাকা দিতে বলছি না। আমরা চাচ্ছি একটা সিস্টেম। এই মুহূর্তে বিশ্ব যেহেতু খুব বিপদ আছে, বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এই অবস্থায় আমাদের সরকারের কিছু উদ্যোগ নিতে হবে।
যদি সরকারের ফান্ড না থাকে, জ্বালানি-বিদ্যুৎ-এ ঘাটতি দিতে না পারে তাহলে ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের যে কয়টি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা আছে, যত রকম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে সবাইকে সরকার চিঠি দিয়ে এটা বাস্তবায়ন করার জন্য বলতে পারে। শুধু চিঠি দিলে হবে না সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে আপাতত বেতন কয়েক মাসের জন্য বাড়িয়ে দিতে হবে। না হলে মানুষ চলতে পারবে না। মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ। আর ডলার রিজার্ভ যদি করতে হয় দেশের বাইরে যাওয়া আপাতত বন্ধ করে দেন। ঘোরাঘুরি বন্ধ করে দেন। এতেও আবার সমস্যা আছে। কারণ ট্যুরিজম সেক্টর বসে যাবে। ট্যুরিজম সেক্টরে যারা কাজ করে তারা বসে যাবে। মানি একচেঞ্জগুলো বসে যাবে। সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে।
কিন্তু আমরা যারা সাধারণ জনগণ আমরা বৈশ্বিক মহামারি, করোনা, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বুঝি না। আমরা চাই বাজারে গিয়ে ১২০ টাকা ১৩০ টাকায় বয়লার মুরগি কিনতে, ৮০ টাকায় ১০০ টাকায় পাঙ্গাস মাছ কিনতে, ৪০ টাকা ৫০ টাকায় চাল কিনতে, ৪০ টাকা ৫০ টাকায় কাঁচামরিচ কিনতে। হাসি মুখে বাজার করে ডাল-ভাত খেতে। এর মধ্যে গোদের ওপর বিষফোঁড়া বিদ্যুৎ। যারা বড়লোক সারাক্ষণ বিকট শব্দে আওয়াজ করে জেনারেটর চালাচ্ছে। আর আমাদের বাসায় আমরা যদি ইউপিএস রাখি সেটাও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইউপিএস-এর দাম বেড়ে যাচ্ছে। এসির বিল বাড়ছে। সব কিছু মিলে আমরা ভালো নেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি মানবতার মা, আমাদের আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল। আপনার দিকেই বাংলার ১৬ কোটি মানুষ তাকিয়ে আছে। আপনি এমতাবস্থায় যদি কোনো পদক্ষেপ না নেন আমরা কোথায় যাবো? সরকারবিরোধী অপপ্রচার নানান কর্মকাণ্ড চলছে চলবে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। যদি সবকিছু স্বাভাবিক থাকে তাহলে কোনো ষড়যন্ত্র করে লাভ হবে না। দেশ এগিয়ে যাবে। কিন্তু একটু ফাক পেলেই ষড়যন্ত্রকারীরা সুযোগ পেয়ে যাবে। আপনি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দর সঙ্গে বসেন। তারা প্রচুর প্রফিট করছে। তাদের লাভের অংশ থেকে এই মুহূর্তে যে মানবেতর জীবনযাপন আমরা করছি চাকরিজীবীরা আমাদের কিছু সহযোগিতা করতে বলুন। আবার যখন দেশ স্বাভাবিক হয়ে যাবে, জিনিসপত্রের দাম কমে যাবে, তখন আমরা আবার সাবেক বেতনে ফিরে যাবো।
যখন করোনা ছিল তাদের লাভ কম ছিল। তখন অনেক প্রতিষ্ঠান ৩০-৪০ শতাংশ বেতন কম দিয়েছে। আমরা মেনে নিয়েছি। কারণ আমরা তখন বাসা থেকে অফিস করেছি। এখন যখন দেশের এই অবস্থা তখন তাদের উচিত কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের বোবা কান্না কেউ দেখছে না। আপনি ছাড়া আর কেউ নেই যে এই সংকটময় মুহূর্তে আমাদের পাশে দাঁড়াবে। একমাত্র আপনিই পারেন লাখ লাখ বেসরকারি চাকরিজীবীদের উদ্ধার করতে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান