সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলা হয়েছিল ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট। ওই ঘটনার পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়ের হওয়া ১৫৯ মামলার মধ্যে ৪১ মামলা এখনো নিম্ন আদালতে বিচারাধীন। চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে চুয়াডাঙ্গায় একটি মামলাসহ এ পর্যন্ত নিম্ন আদালতে ১০২টি মামলার রায় হয়েছে। ঘটনার ১৭ বছরে মাত্র দুটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি মামলাগুলোর বিচার শেষ হবে কবে, এই প্রশ্নই এখন সব মহলে।
জানা গেছে, বার বার সমন দিয়েও সাক্ষী হাজির করতে না পারা, মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্বের অন্যতম কারণ। সঙ্গে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে দীর্ঘদিন আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় মামলা নিষ্পত্তির গতি আরও কমেছে। আইনজ্ঞরা বলেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা আরও সুরক্ষিত করতে চাঞ্চল্যকর এসব মামলার বিচার দ্রুত শেষ করতে হবে। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে আর কেউ এমন অপরাধে জড়াতে সাহস পাবে না। জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর নেই। এখন যে কোনো অপরাধেরই বিচার হয়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টে সারা দেশে যে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছিল, ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বিচার চলমান। করোনার কারণে আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও এখন পর্যায়ক্রমে মামলাগুলোর বিচার শেষ হবে। জানতে চাইলে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের মানুষ একটা ভীতির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। দেশে ঠিক কী হতে যাচ্ছে কেউ বুঝে উঠতে পারছিল না। এরপর জঙ্গিরা দেশে আরও বেশ কিছু অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। তবে বর্তমান সরকার জঙ্গিদের কঠোরভাবে দমনে কাজ করছে। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য সিরিজ বোমা হামলার মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে আসামিদের, যাতে অন্য কেউ এমন জঘন্য কাজে জড়িয়ে পড়তে সাহস না পায়। ঘটনার দিন বেলা ১১টার দিকে দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) একযোগে বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গিরা। মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যবধানে দেশের ৪৫০টি স্থানে চালানো সেই হামলায় পাঁচ শতাধিক বোমা ফাটানো হয়। হামলায় দুজন নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক। হামলা চালানো হয় সুপ্রিম কোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক কার্যালয়, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেস ক্লাব, সরকারি ও আধা সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কাছে। পুলিশ সদর দফতর থেকে পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সিরিজ বোমা হামলার এই ঘটনায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৬৩ জেলায় ১৬২টি মামলা হয়। তিনটি খারিজ হওয়ায় অবশিষ্ট থাকে ১৫৯টি মামলা। এর মধ্যে ডিএমপিতে ১৮টি, সিএমপিতে ৮টি, আরএমপিতে ৪টি, কেএমপিতে ৩টি, বিএমপিতে ১২টি, এসএমপিতে ১০টি, ঢাকা রেঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১১টি, রাজশাহী রেঞ্জে ৭টি, খুলনা রেঞ্জে ২৩টি, বরিশাল রেঞ্জে ৭টি, সিলেট রেঞ্জে ১৬টি, রংপুর রেঞ্জে ৮টি, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ৬টি ও রেলওয়ে রেঞ্জে ৩টি। যার মধ্যে ১৪৩টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ১ হাজার ১৩১ জনকে। এদের মধ্যে ১ হাজার ২৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাকি ১৬টি মামলায় ঘটনার সত্যতা থাকলেও আসামি শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। পুলিশ সূত্র জানায়, চার্জশিট দেওয়া ১৪৩ মামলার মধ্যে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ১০২টি মামলায় নিম্ন আদালতে রায় হয়েছে। এর মধ্যে গত ৮ ফেব্রুয়ারি চুয়াডাঙ্গায় সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় করা মামলার অন্যতম আসামি শায়খুল ইসলাম সাইফুল ওরফে রাকিবকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। জেলার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক লুৎফর রহমান শিশির এ রায় দেন। বর্তমানে আরও ৪১টি মামলা নিম্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। পুলিশ সূত্র আরও জানায়, অনেক মামলায় সাক্ষীদের না পাওয়ার কারণে মামলা শেষ করতে সময় বেশি লেগে যাচ্ছে। বেশির ভাগ সাক্ষীর ঠিকানাও পরিবর্তন হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকার আদালতে সিরিজ বোমা হামলার ১৭টি মামলা ছিল। এর মধ্যে পাঁচটি মামলার এখন বিচার চলছে। আমরা মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে বারবার সমন দিয়েও সাক্ষী পাওয়া যায় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাক্ষী হাজিরে আরও বেশি দায়িত্বশীল হলে দ্রুতই নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।
সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে না পারার বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অপারেশন) মো. হায়দার আলী খান বলেন, আদালতের সমন অনুযায়ী আমরা সাক্ষীদের হাজিরের বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। তবে অনেক সময় দেখা যায় সাক্ষী স্থায়ী ঠিকানায় নেই বা সাক্ষী মারা গেছেন বা সাক্ষীর ঠিকানা পরিবর্তন হয়েছে। তখন আদালতকে বিষয়টি জানানো হয়। আদালত যেভাবে সিদ্ধান্ত দেন সেই অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, ২০০৫ সালের সিরিজ বোমা হামলার পর জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহ, আবদুল আউয়াল, হাফেজ মাহমুদসহ ৯৬১ জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইসহ সাতজনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, খালেদ সাইফুল্লাহ, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল ও ইফতেখার হাসান আল মামুনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।