কুুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ কুড়িগ্রামের উলিপুরে ফেয়ার প্রাইস কার্ড অনলাইনে নিবন্ধন করার নামে কার্ডধারীদের কাছ থেকে ৫০ থেকে ২০০ টাকা করে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। সরকার প্রতিকার্ডের জন্য অনলাইন খরচ ১৫ টাকা ভর্তুকি দিলেও নির্বাচিত প্রতিনিধি, উদ্যোক্তা ও ডিলারা প্রকাশ্যেই হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত এসব কার্ডধারীর কাছ থেকে টাকা আদায় করছে। সংশ্লিষ্টদের সীমাহীন দূর্নীতির ঘটনায় প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় সরকারের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
অন্যদিকে,গত ৩ দিন ধরে সার্ভার সমস্যার কারণে অনলাইন কার্যক্রমে অচলাবস্থা দেখা দেয়ায় শত শত কার্ডধারী তথ্যসেবা কেন্দ্র গুলোতে এসে মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে । এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনলাইন কার্যক্রম শেষ করার বিষয়টি কার্যতঃ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বহুমুখী সমস্যার কারণে কার্ডধারীদের মাঝে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানাগেছে, খাদ্য অধিদপ্তরের নির্দেশে সারাদেশের মতো উলিপুরেও ১০ টাকা কেজি দরের ৩০ কেজি চাল গ্রহীতাদের ফেয়ার প্রাইস কার্ড অনলাইনে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। উলিপুর উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়নে ২৭ হাজার ২৪৫টি ফেয়ার প্রাইস কার্ড রয়েছে। ভোক্তাগণ যাতে করে কার্ড নিবন্ধন করতে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন না হয় এজন্য নিবন্ধন কাজে যুক্ত ইউপি অফিসে সংযুক্ত উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার কার্ড প্রতি ১৫ টাকা বরাদ্দ করেন। বিনিময়ে উদ্যোক্তাদের বিনা টাকায় অনলাইনে ভোক্তাদের কার্ড নিবন্ধন করার কথা। কিন্তু উলিপুর উপজেলায় সরকারের ওই নির্দেশ সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হচ্ছে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ ইউনিয়নে ভোক্তাদের কাছ থেকে কোথাও ৫০ টাকা কোথাও ১০০ কোথাও ২০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। এ ঘটনায় হতদরিদ্র এসব ভোক্তাদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ লক্ষ্য করা গেছে।
উপজেলার বজরা ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে, বজরা ইউনিয়ন পরিষদ এর পরিবর্তে তথ্য সেবা কেন্দ্রটি বজরা বাজারে বসানো হয়েছে। সেখানে অনলাইন করতে আসা কয়েকজন ভোক্তার সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। মধ্য বজরা এলাকার বৃদ্ধা পারুল বেগম জানান, তার কাছ থেকে অনলাইন খরচ ৫০ টাকা নেয়া হয়েছে। একই ভাবে উদ্যোক্তা আব্দুর রহিম রিপন ও তার সহযোগীরা টাকা নিয়েছেন বলে জানালেন,ভোক্তা আছিরন বেওয়া, আহমদ আলী, হাসেন আলী, নুর ইসলাম ও লতা বেগম। কাচভান বেগমের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, শুনছি ৫০ টাকা করে নেয় সে জন্য আমিও টাকা নিয়ে অনলাইন করার জন্য আসছি। এই তথ্যসেবা কেন্দ্রে রাত ১২ টা পর্যন্ত ভোক্তাদের টাকার বিনিময়ে অনলাইন নিবন্ধন করাচ্ছেন।
বজরা ইউপি চেয়ারম্যান কাইয়ুম সরদারের সাথে এ ব্যাপারে কথা হলে তিনি বলেন, আমিও শুনেছি টাকা আদায় করা হচ্ছে, খোঁজ নিয়ে বিষয়টি দেখবো যাতে কেউ টাকা না নেয়।
উলিপুর উপজেলা সদরের পাশেই ধরণীবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ। সেখানে দুপুর ১ টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, তথ্যসেবা কেন্দ্রের সামনে ভোক্তাদের উপচে পড়া ভীড়।
অধিকাংশ ভোক্তার হাতে ১০০ টাকা ট্যাক্স প্রদানের রশিদ। এ প্রতিবেদককের সাথে কথা হয় ভোক্তা মর্জিনা বেগমের, তিনি জানান যারা ১০০ টাকার রশিদ নিয়ে উদ্যোক্তার সামনে যাচ্ছেন শুধু তাদের কার্ড অনলাইনে নিবন্ধন করা হচ্ছে, যারা ট্যাক্স দিতে পারছেন না তাদের অনলাইন করা হচ্ছে না। এখানে রীতিমতো ভয় দেখিয়ে অভাবের এই দিনে ভোক্তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হচ্ছে। টাকা না দিলে কার্ড নিবন্ধন হবে না এ ভয়ে সকলেই ট্যাক্স পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে অভিযোগ অনেকের।
মর্জিনা সহ ১০০ টাকা দিয়ে কার্ড নিবন্ধন করেছেন যারা তারা হচ্ছেন, মুহুবর রহমান ডারার পাড়, ইদ্রিস আলী তেলিপাড়া, মুহুবর মিয়া ডারার পাড়,আরজিনা বেগম তেলিপাড়া, সবদুল ধরনী বাড়ি,আবুল কাশেম ধরণীবাড়ী ও মুন্নাফ আলী ধরণীবাড়ী। ধরণিবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান এরশাদুল হক এ প্রতিবেদককে জানান, ইউনিয়ন পরিষদে কোন আয়ের এর উৎস না থাকায় কার্ড ধারীদের কাছ থেকে ট্যাক্স হিসেবে ১০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। যারা খুব অভাবী তাদের কাছে নেয়া হচ্ছে না।
উপজেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়নের নাম দুর্গাপুর। এখানেও সোমবার বিকেল চারটার দিকে গিয়ে একই কৌশলে টাকা আদায়ের দৃশ্য দেখা যায়। চেয়ারম্যান অত্যন্ত কৌশলে ১০০ টাকা ট্যাক্সের রশিদ দিয়ে টাকা আদায় করাচ্ছেন। তথ্যসেবা কেন্দ্রটি ইউনিয়ন পরিষদে থাকার কথা থাকলেও উদ্যোক্তা ফরিদুল ইসলাম অদৃশ্য কারণে তা পার্শ্ববর্তী বাজারে নিয়ে নিবন্ধন কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এখানেই কথা হয় রাবেয়া বেগম এর সাথে। তিনি অভিযোগ করে বলেন,তার কাছ থেকে উদ্যোক্তা ১০০ টাকা নিয়েছেন আরো ৫০ টাকা না দিলে তাকে অনলাইন নিবন্ধনের রিসিভ কপি দেয়া হচ্ছে না। এমন অভিযোগ সেখানে উপস্থিত অনেকের। এখানে যারা টাকা দিয়ে কার্ড নিবন্ধন করিয়েছেন তারা হচ্ছেন,মমতাজ বেগম দুর্গাপুর মিয়াজীপাড়া, হালিমা বেওয়া সরকারপাড়া দুর্গাপুর,রেজিয়া বেওয়া আনন্দবাজার ধোপাপাড়া,হিতেশ চন্দ্র ও মোতালেব।
নিবন্ধনের নামে টাকা আদায়ের ঘটনায় এসব কার্ড ধারী ভোক্তাদের মাঝে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ ব্যাপারে দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি বলেন,উদ্যোক্তা তার নিবন্ধন খরচ মেনটেনেন্স এর জন্য টাকা আদায় করে থাকলে থাকতে পারে আমার বিষয়টি জানা নাই। আর যাতে টাকা আদায় করা না হয় আমি সে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
একই দৃশ্য চোখে পড়েছে পান্ডুল ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে, সেখানে উদ্যোক্তা মোঃ আব্দুর রহিম আগে থেকেই ঘোষণা দিয়েছেন ৫০ টাকা সহ কার্ড নিয়ে তাদেরকে নিবন্ধনের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে আসতে হবে। কার্ডধারীরা যথারীতি তার কথামতো ৫০ টাকা নিয়ে আসলেও সার্ভারে ত্রুটি দেখা দেয়ায় তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও নিবন্ধন করাতে পারেননি বলে জানান। সার্ভারে ত্রুটির কারণে গত তিনদিন ধরে প্রত্যেকটি ইউনিয়নে কার্ডধারী ভোক্তাগণ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চরম ভোগান্তির শিকার হন। একই অবস্থা ধামশ্রেনী, সাহেবের আলগা, বেগমগঞ্জ, গুনাইগাছ ও তবকপুর ইউনিয়নে। অভাবের এইদিনে অনলাইন নিবন্ধন কার্যক্রম যেনো ভোক্তাদের মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গেছে, উপজেলার বুড়াবুড়ি ও থেতরাই ইউনিয়নে সেখানে কোন টাকা পয়সা ছাড়াই উদ্যোক্তারা নিবিড় ভাবে অনলাইন নিবন্ধন কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এ ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের সাথে কথা হলে তারা বলেন,টাকা গ্রহণ না করার জন্য চেয়ারম্যান এর কড়া নির্দেশ থাকায় এখানে কোন প্রকার টাকা পয়সা নেয়া হয়নি। এছাড়া সরকার নিবন্ধন খরচ বহন করবেন।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মেজবাউল হোসাইন এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, অনলাইন নিবন্ধন কার্যক্রম এর ব্যাপারে ভোক্তাদের কাছ থেকে কোনভাবেই অর্থ আদায় করা যাবে না। এটা বেআইনি হবে।
উলিপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিপুল কুমার বলেন, অনলাইন নিবন্ধন কার্যক্রমে কোন উদ্যোক্তার আর্থিক লেনদেন প্রমাণ হলে ঐ উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। #