সন্তানদের মধ্যে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করা ইসলামের অন্যতম বিধান। সব সন্তানকে সমান চোখে না দেখলে তাদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। তাই পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে সব সন্তানদের সমান চোখে দেখা জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন। আর তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও সীমালঙ্ঘন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।’ (সুরা নাহল: ৯০)
কোনো কিছু দেওয়ার ক্ষেত্রে সন্তানদের মধ্যে সমতা বিধান করতে হবে। নুমান ইবনে বশির (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একবার তাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে রাসুল (স.)-এর কাছে গেলেন এবং বলেন, আমি আমার এ ছেলেকে একটি গোলাম (চাকর) দিয়েছি। রাসুল (স.) তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি তোমার সব সন্তানকেই এমন দিয়েছ? তাঁর বাবা জবাব দিলেন, না। রাসুল (স.) বলেন, তাহলে এ গোলাম ফেরত নিয়ে নাও।’ (বুখারি: ২৫৮৬)
এ হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, সন্তানদের কোনো কিছু দেওয়ার ক্ষেত্রে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করা আবশ্যক। বৈষম্য করা হারাম। পারিবারিক জীবনে ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় হাদিসটির গুরুত্ব অপরিসীম। এ হাদিস পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার এক বড় উদাহরণ। অতএব স্নেহের আতিশয্যে কোনো সন্তানের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়, বরং তা ইনসাফের পরিপন্থী। প্রসিদ্ধ ছয়টি হাদিসগ্রন্থের মধ্যে ‘ইবনে মাজাহ’ ছাড়া বাকি পাঁচটিতেই উপরে উল্লিখিত হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এ হাদিসের কোনো বর্ণনায় এসেছে- ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সন্তানদের মধ্যে ইনসাফ কায়েম করো।’ (মুসলিম: ১৬২৩)
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) জনৈক আনসারী সাহাবিকে ডাকলেন। ইতোমধ্যে ওই সাহাবির এক পুত্রসন্তান তার কাছে এলো। তিনি তাকে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন এবং কোলে বসালেন। কিছুক্ষণ পর তার এক কন্যাসন্তানও সেখানে উপস্থিত হলো। তিনি তার হাত ধরে নিজের কাছে বসালেন। এটি লক্ষ করে রাসুল (স.) বললেন, উভয় সন্তানের প্রতি তোমার আচরণ অভিন্ন হওয়া উচিত ছিল। তোমরা নিজেদের সন্তানদের মধ্যে সমতা রক্ষা করো। এমনকি চুমু দেওয়ার ক্ষেত্রেও। (মুসান্নাফ আবদুর রাজজাক: ১৬৫০১)
এতে বোঝা যায়, সন্তানদের টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় অথবা খাদ্যবস্তু দেওয়ার ক্ষেত্রেও সমতা রক্ষা করা জরুরি। তবে, হ্যাঁ, কারো অসুস্থতার জন্য বা শিক্ষার খরচবাবদ ইত্যাদি বিষয়ে কিছু কমবেশি হতেই পারে, এতে দোষ নেই। কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশ ও সমতা-বিধানের ক্ষেত্রে সন্তানদের মধ্যে কম-বেশি করা যাবে না। এরকম করলে জবাবদিহি করতে হবে।
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে : ‘…যখন তোমরা কথা বলবে, তখন ন্যায্য কথা বলবে—যদিও তা স্বজনদের সম্পর্কে হয়। আর আল্লাহপ্রদত্ত অঙ্গীকার পূর্ণ করো। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।’ (সুরা আনআম: ১৫২)
সন্তানদের জন্য কিছু সঞ্চয় করাও ইসলামের শিক্ষা। সন্তানদের কারো মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়া প্রিয়নবী (স.) কখনোই পছন্দ করেননি। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তুমি তোমার উত্তরাধিকারীদের মানুষের করুণার মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদের সচ্ছল রেখে যাওয়াই উত্তম।’ (বুখারি: ১/৪৩৫; মুসলিম: ৩/১২৫১)
মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে সবাই কমবেশি অসিয়ত করে। এ অসিয়তে যদি কোনো উত্তরাধিকারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চিন্তা থাকে, তাহলে এমন অসিয়ত ইসলামে নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘…এটা (উত্তরাধিকার সম্পত্তির বণ্টন) অসিয়ত আদায় ও ঋণ পরিশোধের পর (কার্যকর হবে), যদি অসিয়ত কারো জন্য ক্ষতিকর না হয়। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও অশেষ সহনশীল।’ (সুরা নিসা: ১২)
এ বিষয়ে মহানবী (স.) বলেছেন, ‘কোনো কোনো ব্যক্তি ৭০ বছর যাবত (গোটা জীবন) নেক আমল করে। কিন্তু অসিয়ত করার সময় জুলুম করে। তখন একটি খারাপ কাজের মাধ্যমে তার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ফলে সে জাহান্নামে যায়। আর কোনো কোনো ব্যক্তি ৭০ বছর যাবত (গোটা জীবন) খারাপ কাজ করে। কিন্তু অসিয়ত করার সময় সে ইনসাফ করে। তখন একটি ভালো কাজের মাধ্যমে তার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ফলে সে জান্নাতে যায়।’ (আবু দাউদ: ২৮৬৭; তিরমিজি: ২১১৭)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সন্তানের অধিকার নিশ্চিত করার তাওফিক দান করুন। সন্তানদের মাঝে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখকঃ- বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।