সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সুপারিশের পরও গেজেটে নাম না আসায় ৪২তম বিসিএসে নিয়োগ পাননি ৩৪ চিকিৎসক। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সব ধাপে মেধার স্বাক্ষর রেখেও কেন বাদ পড়লেন সে প্রশ্নেরও সদুত্তর মিলছে না। সরকারি চাকরি না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন এসব চিকিৎসক ও তাদের পরিবার।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পিএসসি থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে যেসব কারণে প্রার্থিতা বাতিলের কথা বলা হয়েছে, এরকম কোনোকিছুর সঙ্গেই তাদের মিল নেই। তারা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো ধরনের কাজে জড়িত নন। তারপরও কেন এমন হলো তা বুঝতে পারছেন না। এজন্য মেধাক্রমে উত্তীর্ণ চিকিৎসকদের মধ্যে দুজন উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ) আব্দুস সবুর মণ্ডল বলেন, দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাদের যোগ্য মনে হয়েছে, সুপারিশের প্রেক্ষিতে তাদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে। যারা পেন্ডিং (বাদ) রয়েছেন হয়তো বা তাদের কোনো ঝামেলা বা ফৌজদারি অপরাধ আছে। ফের নিরীক্ষা করে তবেই বলা যাবে। তিনি বলেন, সরকার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার জন্য সবসময় সচেষ্ট। একজন শিক্ষার্থী বিসিএস পাশ করে আসছে, অথচ নিয়োগ পাননি। সেক্ষেত্রে অবশ্যই কোনো গুরুতর অভিযোগের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে, না হলে বাদ পড়ার কারণ নেই। তবে যারা রিট করেছেন, ইতোমধ্যে তারা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন। বাকিদের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
জানা যায়, পিএসসি ২০২০ সালে ৪২তম বিশেষ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় ৩১ হাজার চিকিৎসক অংশ নেন। পরীক্ষার এক মাস পর ২৯ মার্চ এই বিসিএসের ফল প্রকাশ করে পিএসসি। এতে উত্তীর্ণ হন ৬০২২ জন। ৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত চূড়ান্ত ফল অনুযায়ী ৫৯১৯ জন উত্তীর্ণ হন। পিএসসি পদ স্বল্পতায় প্রাথমিক চাহিদাসহ ৪ হাজার চিকিৎসককে সহকারী সার্জন পদে নিয়োগের সুপারিশ করে। অবশিষ্ট ১৯১৯ জনকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়। এ ধারাবাহিকতায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ৩৯৫৭ প্রার্থীর নামে গেজেট প্রকাশ করে। ফলে পিএসসি সুপারিশের পরও ৪৩ প্রার্থী চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপনে বাদ পড়েন। ভুক্তভোগীরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দ্বিতীয় তদন্তে ৩০ জনকে বাদ দেয়। বাকিদের রি-ভেরিফিকেশন করে চলতি মাসের ১১ আগস্ট প্রকাশিত দ্বিতীয় গেজেটে ৯ জনকে নিয়োগ দেয়। এতে আগের ৩০ এবং তৃতীয় গেজেটে চারজনসহ মোট ৩৪ জন নিয়োগ বঞ্চিত হন। তবে কেন বাদ পড়ছেন, সে তথ্যও জানানো হয়নি। তারা জনপ্রসশান মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত গেজেটে পুনরায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্তে সরকারের প্রতি দাবি জানান।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) কে-৭২ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাদিয়া রহমান বলেন, তিনি ৪২তম বিসিএসে পিএসসি কর্তৃক সুপারিশকৃত মেধাক্রমে ৬৯তম হন। ৪২-এর গেজেটের পর নিজের প্রতিষ্ঠান, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে, এমনকি বাড়িতে গিয়েও পুলিশ তদন্ত করেছে। সংশ্লিষ্টরা তার বা পরিবারের নামে কোনো বিরূপ মন্তব্য বা অভিযোগ পাননি বলে জানিয়েছিলেন। এরপরও তাকে পারমানেন্ট গেজেট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে-৭২ ব্যাচের আরেক শিক্ষার্থী মারিয়া বলেন, ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করার পর তিনিও ৪২তম বিসিএসে ১৩৮০ মেধাক্রম অর্জন করেন। মৌখিক পরীক্ষায় বেশ ভালো করেছেন। কিন্তু অজানা কারণে গেজেটে নাম আসেনি। এজন্য ঢাকা কলেজের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করেন। দিন শেষে কোনো সমাধান হয়নি। ফলে তিনি ও সাদিয়া রহমান উচ্চ আদালতে রিট করেছেন।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, সারা দেশের হাসপাতালেই চিকিৎসক সংকট রয়েছে। অনেক জায়গায় পদশূন্য আছে। তাই যারা নিয়োগ পাননি তাদের পদায়ন করা উচিত। তাছাড়া মেধাবী চিকিৎসকরা মানুষের সেবাদানের জন্যই এ পেশায় এসেছেন। বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগ না পেলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে। পরিবার হতাশ হবে। ফলে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া উচিত।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সাইফুল হাসান বাদল বলেন, নিয়োগ না পাওয়ার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। তবে ৪২তম বিসিএসে পাশ করেছে কিন্তু সুপারিশপ্রাপ্ত হননি, তাদের ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পিএসসিকে বলার পর ৩৯২ জনকে পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরে নন-ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করেছে। জনপ্রশাসন বিসিএস উত্তীর্ণ চিকিৎসকদের পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ সবকিছু সম্পূর্ণ করার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুধু পোস্টিং ও পদোন্নতি দিয়ে থাকে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিসিএসের ক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া থাকে, যা অনুসরণ করে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেটি না মেনে রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বিবেচনায় বঞ্চিত করা হলে অবশ্যই আপত্তিজনক ও অগ্রহণযোগ্য। কারণ সংবিধানে সব নাগরিকের সমান অধিকার।