ইসলামি হিজরি চান্দ্রবর্ষের দ্বিতীয় মাস সফর।
আরবি ‘সিফর’ মূল ধাতু থেকে উদ্ভূত হলে ‘সফর’ মানে হলো শূন্য, রিক্ত। আর ‘সাফর’ ক্রিয়া মূল
থেকে উৎপন্ন হলে অর্থ হবে হলুদ, হলদেটে, তামাটে, বিবর্ণ, ফ্যাকাশে, ঔজ্জ্বল্যশূন্য, দীপ্তিহীন, রক্তশূন্য ইত্যাদি। তখন আরবরা সৌরবর্ষ হিসাব করত; চান্দ্র মাস গণনা করলেও ঋতু ঠিক রাখার জন্য প্রতি তিন বছর অন্তর বর্ধিত এক মাস যোগ করে ১৩ মাসে বছর ধরে সৌরবর্ষের সঙ্গে সমন্বয় করত। সুতরাং মাসগুলো মোটামুটিভাবে রাশি ও ঋতুতে স্থিত থাকত। ঋতু ও ফল-ফসলের সঙ্গে আমাদের সব কর্মকাণ্ড প্রভাবিত হয়।
মানুষ সাধারণত অবস্থার সঙ্গে সময়কে মূল্যায়ন করে। আরব দেশে সে সময় সফর মাসে খরা হতো এবং খাদ্যাভাব, আকাল ও মঙ্গা দেখা দিত। মাঠঘাট শুকিয়ে বিবর্ণ তামাটে হয়ে যেত। ক্ষুধার্ত মানুষের চেহারাগুলো রক্তশূন্য ও ফ্যাকাশে হয়ে যেত। তাই তারা অবস্থার সঙ্গে মিল রেখে এই মাসের সঙ্গে একটি বিশেষণ যুক্ত করে বলত, ‘আস সাফারুল মুসাফফার’, অর্থাৎ ‘বিবর্ণ সফর মাস’। (লিসানুল আরব, ইবনু মানযুর র.)।
জাহেল আরবরা এই মাসকে দুঃখের মাস মনে করত, এমনকি তারা এ মাসের চাঁদ দেখা থেকে পর্যন্ত বিরত থাকত এবং দ্রুত মাস শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করত। ইসলামি বিশ্বাসমতে, সময়ের সঙ্গে কোনো অকল্যাণ নেই; কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ভর করে মানুষের বিশ্বাস ও কর্মের ওপর। তাই এই মাসের নামের সেই নেতিবাচক বিশেষণ পরিহার করে একটি সুন্দর ইতিবাচক বিশেষণ যুক্ত করে এর নামকরণ করল ‘আস সাফারুল মুজাফফার’, অর্থাৎ ‘সাফল্যের সফর মাস’।
এতে শুধু একটি বর্ণই পরিবর্তন করা হয়েছে। আর সেটিও আরবি একই বর্গের বর্ণ, যাতে তার স্বরধ্বনি ও বর্ণ মাত্রায় তেমন পার্থক্য না হয়েও শব্দটি নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক রূপ লাভ করল; যা ইসলামি সাহিত্যের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্যের স্বাক্ষর বহন করে। ইতিবাচক চিন্তা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ড দ্বারা এই বিবর্ণ সফরকে বর্ণময় করে তোলাই ছিল এর অন্তর্নিহিত দর্শন।
প্রতিটি দিন ও মাসই ফজিলতপূর্ণ। মানুষের জীবন হলো সময়েরই সমষ্টি। সফর মাসও জীবনেরই অংশবিশেষ, সুতরাং সফর মাসও ফজিলতময় ও বরকতপূর্ণ। অতএব আল্লাহ তাআলার রহমত ও বরকত পেতে হলে এ মাসেও বেশি বেশি আমল করতে হবে। ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত যথাযথভাবে আদায় করার পাশাপাশি নফল ইবাদতে মশগুল হতে হবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআন মাজিদে বলেছেন, ‘মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (সুরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১-৩)। এই সুরার শুরুতে আল্লাহ তাআলা সময়ের শপথ করেছেন; এতে বোঝা যাচ্ছে সময় আল্লাহ তাআলার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অতঃপর বিশ্বাস, সৎকর্ম, সদুপদেশ ও ধৈর্যকে সাফল্যের নিয়ামক রূপে বর্ণনা করেছেন। এই হলো ইসলামি সফলতা-ব্যর্থতার মূল কারণ। যাতে কোনো সময়কে অমঙ্গল রূপে চিত্রিত করা হয়নি; বরং সময়কে সফলতার সিঁড়ি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসে আছে: আম্মাজান উম্মে সালমা (রা.) বলেন, একদা রাতে নবীজি (সা.) জাগ্রত হয়ে বললেন, সুবহানাল্লাহ! এ চমৎকার সুন্দর রাত! এতে কত-না বিপদ আপতিত হয়; আর এতে কত-না রহমতের ধনভান্ডার খুলে দেওয়া হয়। (বুখারি, প্রথম খণ্ড, হাদিস নম্বর ১১৬)।
রাত আল্লাহরই সৃষ্টি, এতে মঙ্গল-অমঙ্গল উভয় নিহিত; অর্জিত ফলাফল নির্ধারিত হবে মানুষের কর্মের ওপর ভিত্তি করে। এ রাতের সুবাদে মানুষের জীবনে ভালো বা মন্দ দুটোই ঘটতে পারে। মানুষ ইচ্ছা করলে মঙ্গল কর্ম সম্পাদন করতে পারে অথবা অমঙ্গল। হাদিসে আছে, ‘কোনো অশুভ-অযাত্রা নেই, কোনো ভূতপ্রেত বা অতৃপ্ত আত্মার অশুভ ক্ষমতা নেই এবং সফর মাসের অশুভ কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।’ (বুখারি, পঞ্চম খণ্ড, হাদিস নম্বর ২১৫১,২১৬১, ২১৭১ ও ২১৭৭)।
চান্দ্রমাসের আমল হলো: ১ তারিখ, ১০ তারিখ, ২০ তারিখ ও ২৯-৩০ তারিখ নফল রোজা। ১৩,১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিদের সুন্নত রোজা এবং সপ্তাহে প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার সুন্নত রোজা। চন্দ্র দর্শন, দোয়া পাঠ ও নফল নামাজ বিশেষ ফজিলতপূর্ণ আমল।
তাই সবার উচিত আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে নেক আমল করা। আর প্রতি চন্দ্রমাসে নির্দিষ্ট কিছু আমল থাকে। সে আমলগুলো সফর মাসে করা যেতে পারে। যেমন ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়ামে বিজের তিনটি রোজার প্রতি যত্নশীল হওয়া।
প্রতি মাসে ৩টি রোজা পালনের কথা হাদিসে এসেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আ’মর ইবনে আ’স রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘প্রতি মাসে তিনটি করে সিয়াম পালন, সারা বছর ধরে সিয়াম পালনের সমান” (বুখারীঃ ১১৫৯, ১৯৭৫)
এছাড়া প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার অভ্যাস করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুই দিন বিশেষ রোজা রাখতেন। এ বিষয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- বৃহস্পতি ও সোমবার আল্লাহ তায়ালার সামনে বান্দার আমল উপস্থাপন করা হয়, তাই আমি চাই- আমার আমল পেশ করার সময় আমি যেন রোজা অবস্থায় থাকি। -(সুনানে নাসায়ী, ২৩৫৮)
সর্বোপরি ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্কাদা যথাযথ পালন করার সাথে সাথে নফল দান সদকার প্রতি মনোযোগী হওয়া। নতুন মাসে বরকতের চাঁদ দেখে দোয়া পাঠ করা। মহান আল্লাহ পাক যেন উপরোক্ত আলোচনার উপর আমল করার তাওফিক দান করুন আমিন। লেখকঃ- হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, সাবেক ইমাম ও খতীব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।