শাবলু শাহাবউদ্দিন
চারিদিকে গুটগুটে অন্ধকার। আশেপাশে কি আছে, কারো পক্ষে কোন মতেই বলা সম্ভব না। ডান হাতটা তুলে চোখের সামনে ধরলাম। কই কিছুই তো চোখে পড়ছে না। বাম হাত তুলে ডান হাতের আঙ্গুল গুণলাম। কখনো পাঁচটা কখনো বা চারটা। মনে হলো কোন একটা আঙ্গুল গুণার সময় বাদ পড়ে যাচ্ছে। যাক যা হচ্ছে হোক। আমি সামনের দিকে আগাই। পায়ের তলায় মাটি আছে কী না কিছুই অনুভব করতে পারছি না। কোন দিকে যাচ্ছি তা বলাও হয়তো আমার আপনার কারো কাছে সম্ভব হবে না। এ যেন ডেডেলাসের গোলকধাঁধাঁ। এত অন্ধকার বাপের জন্মে কেউ কোন দিন দেখছে কি না, এ আমার সন্দেহ হচ্ছে। পা চলছে। কানে শুধু হেটে চলার শব্দ আসছে। আকাশে চাঁদ তারা কিছুই দেখছি না। আমার কাছ থেকে বহুদূরে মনে হচ্ছে কিছু একটা জ্বলছে। কি জ্বলছে বলতে পারছি না। জিরাফের মত টানা পা করে ঐ দিকে রওনা হলাম।
অনেক সময় পর ঐ জ্বলন্ত জিনিসের প্রায় কাছে আসলাম। কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। প্রায় একদম কাছে আসতেই চোখে পড়লো, এটা আর কিছু না অগ্নি স্বজ্জিত চিতার বিছানা।
এখানে কেউ আছেন। আমাকে শুনতে পাচ্ছেন। ওহে। কেউ কী আছেন। শুনছেন। হেলো। জোরে জোরে চিৎকার চেচামেচি করছি খেকশিয়ালের মত।
জোরে জোরে চিৎকার চেচামেচি শুনে জ্বলন্ত বিছানা থেকে একজন মানুষ উঠে বসলো।
কে কে? কে আপনি? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
কোন উত্তর দিলোনা ঐ মানুষটি। ভূত পেত তো না। মনে মনে একবার ভাবলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার সংস্কার মন জেগে উঠলো। শুফম এটা কী ভাবা হচ্ছে! ভূত পেত বলতে তেমন কিছু কী আছে!
আমি সজাগ হলাম এবং বললাম, না। এটা তো কুসংস্কার আছন্ন মানুষগুলো মানে। আমি এমনি বলছিলাম। আমার কথার যথার্থ উত্তর পেয়ে আমার মন আমার দেহের মাঝে বিড়ালের মত আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
অগ্নি সজ্জিত বিছানার সন্নিকটে এগিয়ে গেলাম। খুব ভালো করে দেখলাম। আসলে কে ঐই লোকটা।
মুখে লম্বা লম্বা পাকা দাঁড়ি, মনে হচ্ছে বাপের জন্মেও কোন দিন মুচ কাটে নি। শরীর লম্বা আলখেল্লাহ পরিহিত। মাথার সবগুলো চুল পেকে মনে হচ্ছে উলুবন হয়ে গেছে। চুলগুলো লম্বা লম্বা। দেখে মনে হচ্ছে বিচার কোন দিন নাপিতের কাছে যায় নাই। মুখ খানা খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আরো কাছে এগিয়ে গেলাম। অগ্নি সজ্জিত বিছানার একদম নিকটে।
এখন আমি কাকে দেখি। ও মাই গড। এটা কি সত্যি! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- গুরু কেমন আছেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
- হুম। আছি। তুমি কেমন আছো?
- আমি বেশ ভালো আছি।
- আসলে তুমি কে?
- কবিগুরু, আমি শুফম। আধুনিক যুগের তরুণ একজন কবি ও সাহিত্যিক।
- অহ। তা ভালো। তাহলে তোমার কাজ কী?
- কবিগুরু দেখছি ঠাট্টা করছেন। আমি লেখালেখি করি, ঠিক আপনার মতই।
- অহ। তা ভালো। লেখালেখি করে কী করবা?
- কবিগুরু আপনার মত নাম কামাতে চাই। পৃথিবীর বুকে সারাজীবন বেচে থাকতে চাই। অমর হতে চাই গুরু, অমর।
- সব তো বিনাশ। অমরত্ব পাইলা কোথায় তুমি।
- এই যে আপনারা অমর। আপনাদের আত্মা অমর। চিরকাল আপনি এই সোনার বাংলায় বেচে থাকবেন। এটাই তো অমরত্ব।
- দেখ শুফম। এ সব পাগলামী রাখো। ইহজগৎ পরজগৎ সব ভুয়া। মানুষের বানানো। বাংলায় আমার নাম চিরকাল থাকলে তাতে আমার লাভ কী। আমি তো বিনাশ। আমি অমর হলাম কেমনে?
- তাহলে আপনি কী বলতে চাচ্ছেন, গুরু? জগত সংসারে এই যে আমরা আপনাকে এত ভক্তি করি, এত সম্মান করি, সব ভুয়া?
- শুফম, অন্তর খুলে দেখো। তুমি উত্তর পাবা। ঐ যে একদিন তোমরা আমাকে চিতাই তুলে বিনাশ করে দিলে। তারপর থেকেই আমি বিনাশ। আমার কিছুই নেই। আমি দেউলিয়া শুফম, আমি দেউলিয়া। তোমরা আমাকে কী দেও, তা আমি কিছুই জানি না। তার কোন সন্ধানও পাই না। আমি নি:স্ব, আমি দেউলিয়া।
- এই যে ওপর বাংলার কিছু মানুষ আপনার জন্য পূজা করে, সেগুলো আপনি পান না? এই যে আমরা সংস্কারবাদীরা আপনার আত্মার শান্তিতে কত কিছুই না করি, আপনি সেগুলো পান না?
- হাহাহা, শুফম তুমি আসলে পাগল হয়ে গেছো। মানসিক ডাক্তার দেখাও। যার আত্মাই নেই তার আবার শান্তি। তোমরা কীসের সংস্কারবাদী ?
- তাহলে কী আমরা ভুল পথে চলছি, গুরু ?
- সেটা তুমিই ভালো জানো। অন্তর চোখ খুলে দেখো, কোনটা ভুল আর কোনটা সত্য বুঝতে পারবা।
গুরুকে বড্ড ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। সে আবার ঘুমিয়ে পরলো। আমি কিছু সময় বসে রইলাম তার চিতার বিছানার পাশে। তারপরে মনে মনে চিন্তা করলাম বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে দেখা করবো। দেখি তিনি কী বলেন।
- গুরু নজরুলকে দেখতে চাই, কোন দিকে যাবো? তার দেখা কী আমি পাবো?
- কার দেখা পাবা আর কার দেখা পাবা না, সেটা আমি বলতে পারি না। তবে খুঁজে দেখো, তার অস্তিত্ব আছে কী না।
আমি নজরুলের খোঁজে আবার অন্ধকার পথ বেচে নিলাম। চল চল চল।