আবহমান বাংলার হৃদয়কাড়া অপরূপ সৌন্দর্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যমণ্ডিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভরপুর উত্তর জনপদের বিরল প্রাকৃতিক জলসম্পদ দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল। বিশাল অবয়ব আর ঐতিহ্যে ভরা কিংবদন্তির ভাণ্ডার চলনবিলে বর্ষার বিপুল জলরাশি, প্রাকৃতিক মাছ আর অজস্র পাখির সমারোহ যে কোনো পর্যটকের হৃদয় কাড়ে। তাই বর্ষায় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রকৃতিপ্রেমী হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে প্রতিদিন শ শ নৌকা ছুটে বেড়ায় চলনবিলের বুক চিরে। চলনবিলের দর্শনীয় স্থানগুলো মূলত বর্ষাকালেই বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
এ সময়েই থৈ থৈ পানির কারণে সব জায়গায় যাওয়াটাও সহজ। কিন্তু যথাযথ প্রচার না থাকায় দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষের কাছে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনাময় চলনবিল আজও সেভাবে সমাদৃত হয়ে উঠতে পারেনি। তবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা আর প্রচারে সুযোগ পেলে কিংবদন্তির এ চলনবিল দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
জেলার গুরুদাসপুরের খুবজিপুরে অসংখ্য গ্রন্থপ্রণেতা অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদের হাতে গড়া ‘চলনবিল জাদুঘর’ এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান। স্থানীয় এমপি আব্দুল কুদ্দুসের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় তার নিজ এলাকা গুরুদাসপুরের বিলসা, পাশের কুন্দইল ও চলনবিলের বুক চিরে বয়ে চলা বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের ৯ ও ১০ নং ব্রিজ এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও বর্ষায় অসাধারণ হয়ে ওঠে। বর্ষায় এসব এলাকায় রাস্তার উভয় পাশেই দেখা মেলে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির। প্রায় ৩৫০ বছর আগে সিংড়া উপজেলার ডাহিয়া এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে আসা ঘাসী-ই-দেওয়ানের তিশিখালীর মাজার রয়েছে। এখানে শুক্রবারসহ সপ্তাহের অন্যান্য দিন হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে। এর পাশেই বিশাল জলরাশির মাঝে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন পার্ক।
স্থানীয় এমপি আব্দুল কুদ্দুস ও ইউএনও জাহাঙ্গীর আলমের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বড়াইগ্রামের পারকোলে দৃষ্টিনন্দন পদ্মবিল এখন পর্যটকদের কাছে যথেষ্ঠ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
রূপকথার বেহুলা-লখিন্দরের স্মৃতি বিজড়িত বেহুলার কূপ (কুয়া) আজও আছে তাড়াশ উপজেলার বিনসাড়া গ্রামে। সঙ্গেই তার নামে প্রতিষ্ঠিত বেহুলা-লখিন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বেহুলার যাতায়াতে ব্যবহৃত বেহুলার খাড়ি নামের নৌপথ এখনো আছে। খাড়ির পাশে নৌকাসদৃশ ঢিবি আছে। এ ঢিবির নিচে বেহুলার নৌকা রয়েছে বলে বিশ্বাস করে স্থানীয়রা। চলনবিলে রয়েছে আনোয়ারা উপন্যাসের লেখক নজিবর রহমানের মাজার, রায় বাহাদুরের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, দেশের বৃহত্তম গোবিন্দ মন্দির কপিলেশ্বর মন্দির, বারুহাসের ইমামবাড়ি, শীতলাইয়ের জমিদারবাড়ি, হান্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দির ও রায়গঞ্জের জয়সাগর মৎস্য খামার। চাটমোহরের হরিপুরে লেখক প্রমথ চৌধুরী ও বড়াইগ্রামের জোয়াড়িতে লেখক প্রমথ নাথ বিশীর বাড়িসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান বুকে ধারণ করে আছে চলনবিল।
বিলপাড়ের তাড়াশের নবগ্রামে নওগাঁ শাহি মসজিদ (মামার মসজিদ) ও ভাগ্নের মসজিদ নামে দুটি মসজিদ রয়েছে। পাশেই হজরত শাহ শরিফ জিন্দানির (র.) মাজার। জনশ্রুতি আছে, তিনি ষোড়শ খ্রিস্টাব্দে বাঘের পিঠে চড়ে বাগদাদ থেকে এ দেশে এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। চাটমোহরের হান্ডিয়ালে শেঠের বাঙ্গালা ও শেঠের কুঠি মীরজাফরের সহচর জগৎশেঠের বিশ্রামাগার ছিল বলে লোকে এগুলোকে আজো ঘৃণার চোখে দেখে। হান্ডিয়ালে রয়েছে বুড়াপীরের দরগা। চাটমোহরের সমাজ গ্রামে শেরশাহর ছেলে বাংলার সুবেদার সলিমের নির্মিত সমাজ মসজিদ রয়েছে।
তবে বিশ্রামাগার বা রাতযাপনের সুব্যবস্থা না থাকায় দুরাগত ভ্রমণপিপাসুরা বেড়াতে এসে কিছুটা বিপাকে পড়েন। তাই সরকারি উদ্যোগে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য রিসোর্ট নির্মাণসহ যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা আর পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে বৃহত্তম জল সম্পদ চলনবিল হয়ে দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠবে।