চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে বহুল আলোচিত কনটেইনার পাচারের মূল হোতা ছিলেন তৎকালীন কমিশনার (বর্তমানে সদস্য) একেএম নুরুজ্জামান। রাজস্ব লোপাটে একটি বিশেষ সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। পরস্পর যোগসাজশে চক্রের সদস্যরা শুল্কায়ন ছাড়াই অসংখ্য কনটেইনার ছেড়ে দেন। কনটেইনার পাচার মামলায় গ্রেফতার এক আসামির জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য উঠে এসেছে। আলোচিত এ মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। দীর্ঘ তদন্তে কাস্টমসের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অন্তত ৭০ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি মাসেই এ মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হতে পারে। তবে একাধিক সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছে, প্রভাবশালীদের বাঁচানোর জন্য মামলাটির তদন্তে দীর্ঘসূত্রতাসহ নানান জটিলতা ও ফাঁকফোকর সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কারণে শেষ পর্যন্ত তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব নাও হতে পারে। গডফাদারদের কিছুই হবে না-এমন আশঙ্কা অনেকেরই। এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সোমবার বলেন, কনটেইনার পাচারসহ বড় ধরনের অভিযোগ আছে এমন কাউকে যদি বাস্তবে সুরক্ষা দেওয়া হয় তাহলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। কারণ এর মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যাবে-দুর্নীতি করেও সুরক্ষা পাওয়া যায়। এতে কাস্টম হাউজের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি উৎসাহিত হবে। এজন্য সঠিক এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে কাস্টমসের ব্যবহৃত বিশেষ কম্পিউটার সফটওয়্যারের (অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড) পাসওয়ার্ড চুরি করে পণ্যভর্তি ২২টি কনটেইনার পাচার করা হয়। এতে কয়েকশ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় সরকার। যার পুরোটাই চলে যায় পাচারকারী চক্রের পকেটে। এর সঙ্গে কাস্টমসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এ নিয়ে মোট ২১টি মামলা করা হয়। কিন্তু বেশিরভাগ মামলায় তদন্তকালে একাধিকবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল করা হয়। এমনকি নজিরবিহীনভাবে একাধিক মামলায় ৪-৫ দফা তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কনটেইনার পাচার চক্রে তৎকালীন কমিশনার নুরুজ্জামান ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এরা হলেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের তৎকালীন ডিসি নুরউদ্দিন মিলন, এআইআর শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ, রাজস্ব কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ ওরফে ‘ভাইরা হারুন’, এআইআর শাখার কম্পিউটার অপারেটর আব্দুল্লাহ আল মাছুম, ফিরোজ আহমেদ, আব্দুল্লাহ আল নাহিদ, সিরাজুল ইসলাম ও সহকারী প্রোগ্রামার কামরুল হক। এদের প্রায় সবাই বর্তমানে বহাল তবিয়তে সরকারি চাকরি করছেন। সূত্র জানায়, পাচারকৃত কনটেইনারে সিগারেট এবং মদের মতো উচ্চ শুল্কযুক্ত পণ্য খালাস করা হয়। এতে ২১১ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব হারায় সরকার। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি ঢাকার রমনা থানায় মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। পরে অপরাধের বিশদ পরিধি বিবেচনায় আরও ২০টি মামলা করা হয়। আদালতের নির্দেশে সিআইডির পাঁচজন পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে বর্তমানে ২১ মামলার তদন্ত চলছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, তদন্তকালে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়। ইতোমধ্যে ১০ জন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দি : রাশেদ খান নামের এক আসামি তার জবানবন্দিতে সরাসরি তৎকালীন কমিশনার নুরুজ্জামানের নাম ফাঁস করে দেন। ২০২০ সালে ৯ মার্চ ঢাকা মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমানের আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘এই কাজের (কনটেইনার পাচার) মূল হোতা ছিলেন কাস্টমস কমিশনার ড. নুরুজ্জামান, ডিসি (কাস্টমস) নুরুদ্দিন, এআইআর সুলতান আহমেদ এবং আওলাদ ও রাজিব। ওই কর্মকর্তাদের দালাল হিসাবে সিএন্ডএফ এজেন্টদের একটি সিন্ডিকেট জালিয়াতচক্র তৈরি করে। তারা ড. নুরুজ্জামানসহ ওই কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে অসাধু জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের কাস্টম হাউজে অবৈধভাবে পণ্য খালাস করে কোটি কোটি সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিজেরা আত্মসাৎ করে।’ সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আসামির এমন জবানবন্দিতে কাস্টমস প্রশাসনে হইচই পড়ে। ফলে তড়িঘড়ি করে তদন্ত ধামাচাপার চেষ্টা করা হয়। এজন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে কোটি টাকা ঘুসের প্রলোভন দেওয়া হয়। কিন্তু সে চেষ্টা সফল না হলে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ভিন্ন পথ বেছে নেয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে আকস্মিক মেহেরপুরে বদলি করা হয়। পরে নতুন একজন কর্মকর্তা তদন্তের কাজে নিযুক্ত হলেও মামলা অনেকটা ‘ডিপ ফ্রিজে’ চলে যায়। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মামলার তদন্ত পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়ে। সূত্র বলছে, এক পর্যায়ে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া এবং তদন্তের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে মামলার তদন্তভার দুদকে স্থানান্তরের আবেদন করে সিআইডি। এ নিয়ে ফাইল চালাচালির এক পর্যায়ে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অর্থ পাচার এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি সংক্রান্ত অপরাধের তদন্ত শুরু করে সিআইডি। এছাড়া মামলার তদন্ত চলাকালে তৎকালীন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে কর্মরত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর অঢেল অর্থবিত্তের তথ্য পায় সিআইডি। এদের মধ্যে রাজস্ব কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম ওরফে মুকুল, সালাউদ্দিন তালুকদার ও আবু সেলিম মোশারফ হোসেন অন্যতম। তদন্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিআইডির জনসংযোগ শাখার অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার আজাদ রহমান বুধবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ‘তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষে খুব শিগগিরই আদালতে পুলিশ রিপোর্ট দাখিল করা হবে। এদিকে কনটেইনার পাচারকাণ্ডের পর চট্টগ্রাম থেকে কমিশনার নুরুজ্জামানকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে পানগাঁওয়ের কমিশনার হন তিনি। এক পর্যায়ে পানগাঁওকেন্দ্রিক চোরাচালানি চক্র ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিছুদিনের মধ্যেই বিদেশি মদ ও সিগারেট চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠে পানগাঁও। বিদেশি সিগারেটের বড় কয়েকটি চালান আটকের পর কমিশনারের চেয়ার থেকে নুরুজ্জামানকে সরিয়ে এনবিআর-এ সংযুক্ত করা হয়। অধরা ভায়রা হারুন : অভিযোগ আছে-চট্টগ্রাম এবং পানগাঁওয়ে নুরুজ্জামানের প্রধান সহযোগী ছিলেন তার কথিত ভায়রা সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ। ঘুসের অঢেল টাকায় হঠাৎ করে বিত্তশালী হয়ে ওঠেন তিনি। চলাফেরা করেন পাজেরো গাড়িতে। কাস্টমস প্রশাসনে তিনি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত। ২০১১ সালে কাপড় চোরাচালানের অভিযোগে তাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বরাবরই তিনি থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। এছাড়া কনটেইনার পাচারের ঘটনায় অভিযুক্তদের বেশ কয়েকজন এখনো চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজেই কর্মরত আছেন। এর মধ্যে তৎকালীন ডিসি নুরউদ্দিন মিলন বর্তমানে শুল্কায়ন-১ পদে, রাজস্ব কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসুম ৭বি শাখায়, ফিরোজ আহমেদ কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে ৭বি শাখায়, কামরুল হক সহকারী প্রোগ্রামার পদে কর্মরত চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটে এবং ভায়রা হারুন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরে কর্মরত। সূত্র বলছে, কাস্টমসের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও কয়েকটি সিএন্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠান ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। এর মধ্যে দুই প্রভাবশালী সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ওরফে দিপু চাকলাদার এবং হাবিবুর রহমান ওরফে অপু চাকলাদার অন্যতম। জালিয়াতির মাধ্যমে তারা শতকোটি টাকা লুটে নেয়। নুরুজ্জামান যা বললেন : কনটেইনার পাচারে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চাইলে একেএম নুরুজ্জামান বুধবার এনবিআর ভবনে তার কার্যালয়ে যুগান্তরকে বলেন, এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ বিষয়ে একাধিক সংস্থার পক্ষ থেকে তদন্ত করা হয়েছে। কেউ তার সম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে পারেনি। তাছাড়া জবানবন্দিতে নাম এলেই তিনি অভিযুক্ত তা বলা যাবে না। বিষয়টি প্রমাণ সাপেক্ষ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে কমিশনার থাকাকালে কোনো বিশেষ সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বা যোগাযোগ কোনোটিই তার ছিল না। তিনি ১ বছর ২ মাসের মতো সেখানে কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। কম্পিউটার পাসওয়ার্ড চুরি করে পণ্য খালাসের সময়কালে তিনি ছুটিতে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তিনি আরও বলেন, পেশাগত জীবনে সুনামের সঙ্গে সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন। পরপর ২ বার শ্রেষ্ঠ কমিশনার মনোনিত হন। এসব কারণে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে তাকে এ ঘটনায় জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে।