ব্যাংকে ডলার সংকটের কারণে বিদেশ থেকে সার আমদানি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংকট এতটাই প্রকট যে ব্যবসায়ীরা আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে জটিলতায় ভুগছেন। এতে বিদেশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিল পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে না।
সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে সার আমদানির জন্য ৫১৯ কোটি (৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার জোগানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে পদক্ষেপ নিতে চিঠি দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
সম্প্রতি দেওয়া ওই চিঠিতে বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রতুলতার কারণে সার আমদানি বিল পরিশোধে বিলম্ব ও এলসি খোলা জটিলতা দেখা দিয়েছে। এতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিসিআইসি এবং বিএডিসির সঙ্গে সরবরাহকারী উদ্যোক্তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে।
জানতে চাইলে কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, সার আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংক রেটে দিয়েও অনেক বেসরকারি ব্যবসায়ী ডলার পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলোও দিতে চাচ্ছে না-এমন অভিযোগ আমাদের কাছে আসছে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করতে বলেছি। বিশেষ করে সারের মতো অতি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে ডলার দিতে বলা হয়েছে।
ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার এনে এরপর আমদানিকারকদের দিচ্ছে। আমদানিকারকরা ডলার ১০৭ টাকা মূল্য দিয়েও পাচ্ছে না। সার আমদানির ক্ষেত্রে ডলারপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
এদিকে যথাসময়ে আমদানি ও স্বীকৃত বিলের দায় পরিশোধ করতে ব্যাংকগুলোকে ২৬ অক্টোবর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে বলা হয়, যথাযথভাবে আমদানি বিল পরিশোধ না হওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে নির্ধারিত সময়ে স্বীকৃত বিলের দায় পরিশোধে ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বৈদেশিক ব্যবসার অনুমোদন (এডি লাইসেন্স) বাতিলসহ দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়।
জানা যায়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সারের মূল্য ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। অর্থ বিভাগের হিসাবে ২০২১ সালের জুনের তুলনায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বিশ্ববাজারে সারের মূল্য বেড়েছে ১০২ শতাংশ। এর মধ্যে ডিএপির মূল্য ৪৭ শতাংশ, এমওপি সার ১৭৭ শতাংশ এবং টিএসপি বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। কিন্তু বিশ্ববাজারে বাড়লেও দেশে কৃষকের সারের দাম বাড়ানো হয়নি।
ফলে বর্তমান এক কেজি ইউরিয়া সার ২২ টাকায় ক্রয় করছেন কৃষক। এছাড়া টিএসপি ২২ টাকা, ডিএপি, এমএপি ও এমওপি ১৬ টাকা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। আর দাম না বাড়ানোর কারণে এরই মধ্যে অর্থ বিভাগ ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা সারের ভর্তুকি ছাড় করেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে চালসহ খাদ্যশস্য উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে এ বছর বিদেশ থেকে সার আমদানি করতে হবে ৫৮ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। এজন্য প্রয়োজন হবে ৫১৯ কোটি মার্কিন ডলার, দেশীয় মুদ্রায় ৫৬ হাজার ৫২ কোটি টাকা।
কিন্তু ডলার সংকটে আমদানি ব্যাহত, বিল পরিশোধে বিলম্ব, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি-এমন বাস্তবতা তুলে ধরে এরই মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) এবং বেসরকারি উদ্যোক্তারাও। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে চিঠি দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
সূত্রমতে, কৃষি মন্ত্রণালয় চিঠিতে বলেছে, রাসায়নিক সার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর কৃষি উপকরণ। ফলে এর চাহিদা অনুযায়ী সরবারহ নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। সার আমদানির জন্য চলতি অর্থবছরে ৫১৯ কোটি (৫ বিলিয়ন) ডলার ব্যয় হতে পারে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৫৬ হাজার ৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার আমদানি করা হবে।
প্রতি মেট্রিক টনের সম্ভাব্য মূল্য ৭৫০ ডলার (১ ডলার মূল্য ১০৮ টাকা)। এতে ইউরিয়া সার আমদানিতে সম্ভাব্য বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন ১৫০ কোটি ডলার। এ বছর টিএসপি সারের প্রয়োজন ৯ লাখ মেট্রিক টন। টনপ্রতি ৯০০ ডলার হিসাবে প্রয়োজন ৮১ কোটি মার্কিন ডলার।
একইভাবে ডিএপি সার আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন ১৯৫ কোটি মার্কিন ডলার। এ বছর ডিএপি সার আমদানি করতে হবে ১৯ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। প্রতি টনের সম্ভাব্য মূল্য ধরা হয়েছে এক হাজার ডলার। এছাড়া এমওপি সার আমদানিতে ৯০ কোটি ২৫ লাখ ডলারের দরকার। প্রতি টনের মূল্য ধরা হয়েছে ৯৫০ ডলার। সর্বশেষ ২৫ হাজার মেট্রিক টন আমদানি করা হবে এমএপি সার।
এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা পৌনে ৩ কোটি ডলার লাগবে। প্রতি টনের মূল্য ধরা হয়েছে ১১০০ ডলার। তবে সেখানে বলা হয়, এই হিসাব আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য এবং ডলারের বিনিময় হারের ওপর নির্ভরশীল। ফলে আন্তর্জাতিক মূল্য এবং মুদ্রা বিনিময় হার হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে মোট ব্যয়ের অর্থের পরিমাণ কমবেশি হতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের বাজেটে সার আমদানির প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ আছে। এখন ব্যাংকগুলোকে ডলার জোগান নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে যে চিঠি আসছে, সে আলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলা আছে। তিনি আরও বলেন, সার সংকটে খাদ্য উৎপাদনে যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়, সেটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে ৩ নভেম্বর সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে কাতার ও আরব আমিরাত থেকে ৯০ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রতি টন ৬২৬ ডলার হিসাবে ব্যয় হবে ৫৯৭ কোটি টাকা। এছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয় ২৫ হাজার মেট্রিক টন টিএসপি সার আমদানি করবে। ব্যয় হবে ১৪৯ কোটি টাকা।
এর আগে ১৯ অক্টোবর বিএডিসির মাধ্যমে কানাডা থেকে ৫০ হাজার টন এমওপি সার মরক্কো থেকে ৪০ হাজার টন সার ডিএপি আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৭ কোটি ডলার। এছাড়া ১২ অক্টোবর ১ লাখ মেট্রিক টন আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৬৫ লাখ ডলার।
২৮ সেপ্টেম্বর কাতার থেকে ৩০ হাজার টন ও সৌদি আরব থেকে ৩০ হাজার টন ইউরিয়া সার আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় সাড়ে ৫ কোটি ডলার। ১৪ সেপ্টেম্বর কানাডা থেকে ৫০ হাজার টন মিউরেট-অব-পটাশ (এমওপি) এবং মরক্কো থেকে ৪০ হাজার টন ডিএপি সার আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। ব্যয় ধরা হয় ৭ কোটি ডলার। এছাড়া ৩ আগস্ট সৌদি আরব থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৩ লাখ ৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ব্যয় হবে ২০৫ কোটি ডলার। সংশ্লিষ্টদের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার অর্থের জোগান নিশ্চিত করা হলে এসব অনুমোদিত সার আসতে কোনো সমস্যা হবে না।