চলতি বছর ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ প্রাণহানির ঘটনা ঘটল। ১ জানুয়ারি থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত এ রোগে ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ডেঙ্গুতে এতো মৃত্যু কখনও হয়নি। ২০০০ সাল থেকে রোগটির তথ্য সংরক্ষণ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এতে দেখা যায়, এর আগে ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল। সে বছর সর্বোচ্চ ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন আক্রান্ত এবং ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়। তবে এ বছর দুই মাস বাকি থাকতেই সেই রেকর্ড ভাঙল।
গতকাল আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। আর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৮৮ জন। নতুন আক্রান্তদের নিয়ে চলতি বছর আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ১৯৯। ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে ৯৩ জনের মৃত্যুর তথ্য দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০০২ সালে মৃত্যু হয় ৫৮ জনের। এর পর ২০১৮ সাল পর্যন্ত মৃত্যু বছরে ৫০ জনের নিচে ছিল।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা সর্বমোট ৩ হাজার ৭০৭ জন রোগীর মধ্যে ২ হাজার ২৫৪ জনই ঢাকার বাসিন্দা। আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৩৮ হাজার ২৯৫ জন।
কীটতত্ত্ববিদ ও সংশ্নিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ স্থায়ী হতে শুরু করেছে। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সারা বছর এডিস মশা নিধন ও মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস কর্মসূচি রাখতে হবে। তবে মৌসুম এলে দুই থেকে তিন মাস ডেঙ্গু নিধন কর্মসূচি পালন করে দুই সিটি করপোরেশন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রচারণা থাকলেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সিটি করপোরেশনগুলো ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ২০১৯ সালের চেয়ে এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কম হলেও মৃত্যু বেশি। এজন্য দেরিতে হাসপাতালে আসাকে দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালে ভর্তির ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ৮১ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৪০ থেকে ৮০ বছর বয়সীরা বেশি মারা গেছেন। মোট মৃত্যুর ৪৮ শতাংশ এই বয়সী। এবার তরুণরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। মোট আক্রান্তের ২৮ শতাংশই তরুণ। ঢাকায় বেশি রোগী শনাক্ত হলেও মোট মৃত্যুর ৮৩ শতাংশই এ বিভাগের বাইরে।
বিশেষজ্ঞরা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগের অভাব এবং বর্তমান পরিস্থিতির জন্য জাতীয় ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ সেলের অনুপস্থিতিকে দায়ী করেছেন। এ বছর এ রোগে বেশি মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, দেরিতে হাসপাতালে আসা অন্যতম কারণ। এ ছাড়া কারও কারও একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া এবং শক সিমড্রমে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। পরিস্থিতি দেখা মনে হচ্ছে, ডিসেম্বর পর্যন্ত এর প্রকোপ চলতে থাকবে। এখন থেকে দেশে সারা বছর ডেঙ্গু রোগী মিলবে।
তিনি বলেন, অক্টোবরের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রভাব আছে। অক্টোবরে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে এবং এডিস মশার ঘনত্বও এ সময় বেশি ছিল। এ ছাড়া এ বছর মে থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছিল। আমরা তা কমাতে পারিনি। চলতি বছর ৬২টি জেলায় রোগটি ছড়িয়েছে। কিন্তু জেলা পর্যায়ে মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যক্রম নেই, জনবলও নেই।
কীটতত্ত্ববিদ ও বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, এডিস মশা নির্মূলে সিটি করপোরেশন যথাসময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। মানুষকে সচেতন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা লোক দেখানো কিছু কাজ করেছে মাত্র। এ রোগ নিয়ন্ত্রণে সারা বছরই ডেঙ্গু নিধন কর্মসূচি চালু রাখতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, বছরে দু’একদিন বাদে সারা বছর এডিস মশা নির্মূলে কর্মসূচি চলমান থাকে তাঁদের। এমনকি রোগীদের চিকিৎসায় ভালো ব্যবস্থা রেখেছেন তাঁরা।