রাইস ট্রান্সপ্লান্টার বা ধানের চারা রোপণ যন্ত্রের উপযোগী ট্রে’তে ম্যাট টাইপ চারা উৎপাদনের একটি সাশ্রয়ী বীজ বপনযন্ত্র উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)-এর ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের বিজ্ঞানীরা।
শনিবার সকালে ব্রির ফার্ম মেশিনারি বিভাগের সভাকক্ষে ব্রি বীজ বপনযন্ত্র হস্তান্তর শীর্ষক কর্মশালা শেষে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক, দেশীয় উদ্যোক্তা ও ব্যবহারকারী কৃষকদের মধ্যে যন্ত্রটি হস্তান্তর করা হয়।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মো. মাহবুবুল হক পাটওয়ারী, অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ), কৃষি মন্ত্রণালয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ব্রি’র পরিচালক (প্রশাসন ও সাধারণ পরিচর্যা), ড. মো. আবু বকর ছিদ্দিক। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন পরিচালক (গবেষণা) ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান।
কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ‘যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদের লক্ষ্যে খামার যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধিকরণ (এসএফএমআরএ) প্রকল্পের’ প্রকল্প পরিচালক ও ব্রি’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. একেএম সাইফুল ইসলাম।
বিজ্ঞানী সাইফুল ইসলাম জানান, ট্রে’তে কম সময়, স্বল্প শ্রম এবং সমভাবে বীজ ছিটানোর জন্য বীজ বপনযন্ত্র উদ্ভাবন করেছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপণে অধিক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। যন্ত্রের সাহায্যে ধানের চারা রোপণের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। রোপণ যন্ত্রে ব্যবহারের জন্য ম্যাট টাইপ পদ্ধতিতে চারা তৈরি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বর্তমানে উদ্যোক্তা ও ব্যবহারকারী কৃষকদের এই কাজটি হাতে করতে হয়। হাতে বীজ ছিটানো শ্রমসাধ্য, সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল কাজ। তাছাড়া এতে সমভাবে বীজ ছিটানো যায় না। কৃষকের শ্রম লাঘবের জন্য যন্ত্রের সাহায্যে ম্যাট টাইপ চারা তৈরিতে সমভাবে বীজ ছিটানো অত্যাবশ্যকীয়। সমভাবে বীজ না ছিটালে মিসিং হিলের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই কাজকে সহজ ও দ্রুত করার জন্য এই যন্ত্রটি ব্যবহার করে কমিউনিটি বেইজ চারা তৈরির মাধ্যমে গ্রামীণ উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সহায়তা করবে।
সাইফুল ইসলাম আরও জানান, যন্ত্রটি ওয়ার্কশপে স্থানীয় সহজলভ্য কাঁচামাল দিয়ে খুব সহজে তৈরি করা যায়। যন্ত্রটি স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী/পুরুষ চালাতে পারেন। প্রতি ট্রে’তে অংকুরিত বীজ ছিটাতে ১ (এক) সেকেন্ড সময় লাগে। যন্ত্রটি দিয়ে প্রতি ট্রে’তে ৯৫ থেকে ১৬০ গ্রাম অংকুরিত বীজ বপন করা যায়। একজন শ্রমিক প্রতিদিন ১৪৪০০টি ট্রে’তে বীজ বপন করতে পারে। যন্ত্রটির সাহায্যে বীজ বপনের পর ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে ওপরের স্তর (৬ মিমি) কভার করা যায়। বিভিন্ন জাতের ধানের জন্য বীজ বপনের হার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যন্ত্রের ওজন (৯ কেজি) কম হওয়ায় সহজেই হাতে বহন করা যায়। হপারের বীজ ধারণ ক্ষমতা ৯ কেজি হওয়ায় প্রতিবার ৬০ থেকে ৭৫টি ট্রে তৈরি করা যায়। যন্ত্রটির আনুমানিক বাজার মূল্য ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) রবীন্দ্র শ্রী বড়ুয়া বলেন, পৃথিবীর প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে ব্যবহারিক দিককে গুরুত্ব দিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুত করতে হবে। আমদানি নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজের যে বিশাল বাজার তা নিজেরাই ব্যবহার করতে হবে। তাহলে কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক, দেশীয় উদ্যোক্তা ও ব্যবহারকারী কৃষক সবাই লাভবান হবেন।
বিশেষ অতিথি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) মো. মাহবুবুল হক পাটওয়ারী বলেন, দেশে প্রায় ১৫০০ রাইস ট্রান্সপ্লান্টার বা ধানের চারা রোপণ যন্ত্র মাঠ পর্যায়ে ব্যবহার হচ্ছে। তাদের জন্য ধানের চারা রোপণ যন্ত্রের উপযোগী ট্রে’তে ম্যাট টাইপ চারা উৎপাদন একটি চ্যালেঞ্জ বা কষ্টকর কাজ। এই যন্ত্রটি উদ্ভাবনের ফলে সে কাজটি অনেকটা সহজ হয়ে যাবে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, আমাদের কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বিদেশ নির্ভরতা কমাতে ব্রি নিরলসভাবে কাজ করছে। ধান রোপণ থেকে কাটা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি সহজ ও সাশ্রয়ী করার জন্য ব্রি পরিকল্পনামাফিক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করছে। যার সুফল কৃষকরা পেতে শুরু করেছেন এবং আশা করা যায় অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই ধান চাষ শতভাগ যান্ত্রিকীকরণের আওতায় চলে আসবে। এ ব্যাপারে আমরা বদ্ধপরিকর।
কর্মশালা শেষে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর প্রাথমিকভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়ার মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে বীজ বপনযন্ত্র হস্তান্তর করেন। সমন্বিত যান্ত্রকীকরণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম মহাপরিচালকের পক্ষে এটি গ্রহণ করেন। তিনি জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ক্রমান্বয়ে যন্ত্রটি মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণে কাজ করবে। পরে উদ্যোক্তা ও ব্যবহারকারী কৃষকদের মধ্যেও যন্ত্রটি বিতরণ করা হয়।