ডলার সংকটে জ্বালানি তেল আমদানির অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফিন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) থেকে ঋণ নিয়ে জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। বিপিসি তেল বিক্রি করে আমদানির ছয় মাসের মধ্যে তা পরিশোধ করে। কিন্তু বর্তমানে তীব্র ডলার সংকটের কারণে আইটিএফসির দেনা বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধ করতে পারছে না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে এক বছর বা তারও বেশি করার আবেদন করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে বিপিসি। এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কাছেও মতামত চাওয়া হয়েছে। এ নিয়ে এখন সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। একই সঙ্গে আইটিএফসির সঙ্গেও আলোচনা করছে সংস্থাটি। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ৮ নভেম্বর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বিপিসি। এর গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৬ নভেম্বর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এরপর ৩০ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে মতামত চেয়ে চিঠি দেওয়া হয় ইআরডির কাছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ইআরডি থেকে এখনো মতামত দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। তাদের মতামত পাওয়া গেলে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী আইটিএফসি থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। আমদানি করা তেল বিপিসি বিক্রি করে সংগৃহীত অর্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা করে। ব্যাংক ওই অর্থ দিয়ে ডলার কিনে আইটিএফসির ঋণ পরিশোধ করে। প্রতি এলসির ঋণ পরিশোধে বিপিসিকে ছয় মাস সময় দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ডলার সংকট প্রবল হওয়ায় ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার দিতে পারছে না। যে কারণে বিপিসি এলসি খোলা ব্যাংককে টাকা দিলেও ডলারের অভাবে ঋণ শোধ করতে পারছে না। এর আগে কখনো বিপিসির কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়নি। এবারই এই প্রথম এ ধরনের সমস্যা হলো। ডলার সংকটের কারণে আইটিএফসির ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় ছয় মাস থেকে এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
সূত্র জানায়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে বাড়তি চড়া সুদ দিতে হবে। এতে ঋণের বোঝা আরও বাড়বে। একই সঙ্গে নতুন ঋণ পেতেও সমস্যা হতে পারে। বিপিসির সঙ্গে আইটিএফসির দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান (সচিব) এবিএম আজাদ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে এমনটা হয়েছে। সেজন্য আমরা আমাদের সর্ভিস প্রোভাইডার আইটএফসির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি। এ বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ইআরডিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জায়গায় জানিয়েছি। এখন তাদের উদ্যোগ, মতামত এবং পদক্ষেপের ফলে সবাই মিলে পরবর্তী সমরয় একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুদ বৃদ্ধির বিষয়ে এখনো কোনো কথা বলা হয়নি। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতি সবারই জানা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এমনটা হওয়ার কথা নয়। কেননা অপরিহার্য পণ্য আমদানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। তাহলে জ্বালানি তেলের মতো একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ঋণ পরিশোধে কেন ডলার পাওয়া যাবে না। এখানে সমস্যা কোথায়, সেটি খুঁজে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে বিপিসির ব্যবস্থাপনায় কোনো সমস্যা আছে কি না, সেটিই বড় প্রশ্ন। তিনি আরও বলেন, জ্বালানি তেল আমদানিতে সমস্যা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হবে। এ কারণে শিল্পের উৎপাদন বিঘ্নিত হবে। ফলে রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে। কাজেই এ বিষয়ে এখনই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি অপরিশোধিত তেলের পার্সেল বর্তমানে ৯ কোটি মার্কিন ডলারে খোলা হচ্ছে। আগে এটি ৩ থেকে ৬ কোটি ডলার ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ২০২০ সালে প্রতি ব্যারেল ৩০ ডলারে নেমে যায়। করোনার পর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত মার্চে তা বেড়ে সর্বোচ্চ ১২৩ ডলারে ওঠে। যে কারণে তেল আমদানিতে ঋণও বেড়েছে। যদিও এখন তেলের দাম কমে প্রতি ব্যারেল ৮১ ডলারে নেমেছে।
ওই সময়ে চড়া দামে যেসব এলসি খোলা হয়েছিল, সেগুলোর ঋণের কিস্তি এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। যে কারণে ঋণের কিস্তি বেশি। এছাড়া রয়েছে ডলার সংকট। দুটো মিলে কিস্তি শোধে সমস্যা হয়েছে।
আগে জ্বালানি তেল আমদানির ডলার ব্যাংকগুলোই নিজস্ব উৎস থেকে দিতে পারত। কেননা রপ্তানি আয় দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানোর পর রেমিট্যান্স থেকে আরও ৪০ শতাংশ অর্থব্যয় হতো। ফলে রেমিট্যান্সের ৬০ শতাংশ অর্থ জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য খাতের পণ্য আমদানিতে ব্যয় হতো। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোড ডলার নিতে হতো না। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। অন্যদিকে রপ্তানির তুলনায় আমদানি দ্বিগুণ বেড়েছে। এছাড়া রেমিট্যান্স কমেছে। এতে ডলার সংকট প্রকট হয়েছে। ফলে আমদানি ব্যয় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলারের জোগান বাড়াতে হয়েছে। এতে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আইটিএফসিকে ঋণ শোধের জন্য প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। এ কারণে নির্দিষ্ট তারিখের পরিবর্তে ৩-৪ কিস্তিতে পরিশোধ করা হচ্ছে। এটি আন্তর্জাতিক চলিত নিয়মের পরিপন্থি।
সাধারণ আইটিএফসি ঋণের অর্থ নির্ধারিত তারিখের পরে পরিশোধ কিংবা রিপেমেন্ট দেরি হলে নির্ধারিত সুদের ওপর অতিরিক্ত লাইবরের (লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার্ড রেট) সঙ্গে ২ শতাংশ হারে খেলাপি সুদ গ্রহণ করে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে রাষ্ট্রাত্ত ব্যাংকগুলো রিপেমেন্টে ৩/৪ দিন দেরি করলেও বর্তমানে তারা এই সুদ নিচ্ছে না। বিপিসির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক এবং আইটিএফসি প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে। তবে এরকম দেরি হতেই থাকলে খেলাপি সুদ বা বিলম্ব চার্জ পরিহার করা সম্ভব নাও হতে পারে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি, দেশের অভ্যন্তরে ডলার স্বল্পতা এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নসহ নানা কারণে ঋণ পরিশোধের সময় ৬ মাস বাড়ানোর প্রয়োজন। এক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরের জন্য আইটিএফসির অনুমোদিত ১৪০ কোটি ডলার রিপেমেন্ট (পরিশোধ) সময় ৬ মাসের পরিবর্তে ১ বছর বা তারও বেশি সময় বাড়ানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে।