একাত্তরের ডিসেম্বরের এ সময়টাতে এসে চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায় বাংলাদেশ। বাঙালির নিজ দেশের আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র থেকে তীব্র হতে থাকে। দেশের অধিকাংশ জেলা ইতোমধ্যে হানাদারমুক্ত হয়। ঢাকায় পরিকল্পিত হামলা চালিয়ে শত্রুদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। পালানোর পথ না পেয়ে নানা ধরনের ফন্দিফিকিরে ব্যস্ত পাকিস্তানিরা। এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যুদ্ধের মাঠে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। তাদের সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়ে। তবে তারা পালানোর পথ খুঁজে পাচ্ছিল না।
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ছিল শুক্রবার। এদিন খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে দায়িত্ব পালন করছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমীন। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করে প্রতিরোধ গড়ে তিনি শহিদ হন। বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনী কয়েকদিন ধরে সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ চালায়। এদিন মিত্রবাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো ঢাকা বেতার কেন্দ্রের ওপর আক্রমণ করে এবং কুর্মিটোলার ওপর বারবার রকেট হামলা করে।
মিত্রবাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। কয়েকটি জাহাজভর্তি পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গোপসাগর দিয়ে পালানোর সময় ধরা পড়ে। একটি জাহাজে নিরপেক্ষ দেশের পতাকা উড়িয়ে পাকিস্তানি বাহিনী সিঙ্গাপুর পালানোর পথে মিত্র নৌবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। সম্মিলিত বাহিনী উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধে সর্বাত্মক সাফল্য অর্জন করে। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরের শত্রু বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এদিন রংপুর ও দিনাজপুর জেলা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করা হয়। রাতে পাকিস্তানি বাহিনী জামালপুর গ্যারিসন ছেড়ে ঢাকার দিকে পালানোর সময় শহরের অদূরে যৌথবাহিনীর মুখোমুখি হয়। এ যুদ্ধে প্রায় ১ হাজার ৫০০ পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। বাকিরা আত্মসমর্পণ করে।
বিজয়ের ৫১ বছরে এসে মূল্যায়নের প্রশ্নে সংস্কৃতিজন এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ যুগান্তরকে বলেন, দুই দিক থেকে বিষয়টিকে বিবেচনা করা যায়। একটি অর্জন এবং অন্যটি অপ্রাপ্তি। অর্জনের দিক থেকে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ির কথিত বাংলাদেশ আজকে উন্নয়নের মডেলে পরিণত হয়েছে। হতদ্ররিদ্র মানুষের সংখ্যাও কমেছে। যদিও সাম্প্রতিক করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা পৃথিবীতে মন্দা, ধস এবং দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। সেটা বাংলাদেশেও আছে। আন্তর্জাতিক এই ইস্যুর কারণে আমাদের অর্থনীতিও কিছুটা সংকটে পড়েছে। এটি সামগ্রিক অগ্রগতির বিবেচনায় বড় কোনো বিষয় নয়। তবে দেশে বৈষম্য বেড়েছে এবং সেটি কমা উচিত। সর্বোপরি বাংলাদেশ একটি মর্যাদার আসনে আসীন হয়েছে। বাঙালি হিসাবে সারা পৃথিবীতে আমরা গৌরববোধ করছি।
তিনি বলেন, তবে একদিক থেকে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। সম্প্রীতির জায়গাটিকে আমরা এখনো স্পষ্ট করতে পারিনি। এমনকি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে আকাঙ্ক্ষা ছিল তাও বাস্তবায়ন করতে পারিনি। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য বহু লড়াই সংগ্রাম আমরা করেছি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে কিন্তু গণতান্ত্রিক মানসিকতা এখনো আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে সেভাবে পরিলক্ষিত নয়। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে, কিন্তু মনে রাখতে হবে এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। মানুষের মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য একসঙ্গে কাজ করতে হবে।