বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এলেই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিজ্ঞজনরা তাদের মতপ্রকাশ করেন। আলোচনায় রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ছাড়াও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হয়। এসব অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে বাংলাদেশের অসীম সাহসী তেজোদীপ্ত কিছু বাঙালি বিমানসেনার আকাশযুদ্ধ নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়। ‘বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত’ মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে সেদিন যে কজন বিমানসেনা মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে দখলদার পাকিস্তানিদের যুদ্ধক্ষমতা ধ্বংস করেছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে সত্যিই বিরল। সেই দুঃসাহসিক অভিযান যেন মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়। যে সীমিত রিসোর্স নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠন করা হয়েছিল, তা সামরিক ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
১৯৭১ সালে যুদ্ধের ময়দানের তীব্রতা যতই বেড়েছে, পাকিস্তানিরা ততই কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল। এরই মধ্যে পাকিস্তানের বিভিন্ন বিমানঘাঁটি থেকে বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসার এবং আনুমানিক দুইশ বিমান ক্রু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। তাছাড়া পিআইএ-এর বেশ কয়েকজন বৈমানিকও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধের এ পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার বিমানবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। মে মাসে একে খন্দকার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে বিমানবাহিনী গঠন নিয়ে আলোচনা করেন। একে খন্দকারের অনুরোধ শুনে তাজউদ্দীন আহমদ এ বিষয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে তাকে আশ্বস্ত করেন। এর অনেকদিন পর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তাজউদ্দীন তার অফিসে ভারত সরকারের সচিব কেবি লাল, ভারতীয় বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চান্দ দেওয়ান ও একজন সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে বিমানবাহিনী গঠন নিয়ে আলোচনা করার জন্য একে খন্দকারকে ডেকে পাঠান। এসব কর্মকর্তার সঙ্গে তেমন কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা হলো না। আলোচনাকালে ভারতীয় কর্মকর্তারা বাঙালি অফিসারদের ভারতীয় স্কোয়াড্রনের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাব একে খন্দকারের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। তিনি বরং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে বলেন, ‘সবচেয়ে উত্তম সমাধান হবে, যদি ওনারা আমাদের কয়েকটি বিমান ও কিছু আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য একটি এয়ারফিল্ডের ব্যবস্থা করেন।’ আগস্টের শেষদিকে ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল পিসি লাল কলকাতা সফরে এলে একে খন্দকার তার সঙ্গে দেখা করে একই প্রস্তাব দেন। পিসি লাল তাৎক্ষণিক কোনো পজিটিভ উত্তর দিতে পারেননি। এরপরও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিমানযুদ্ধে বাঙালি বৈমানিকদের অংশগ্রহণের বিষয়টি আলোচিত হতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত একে খন্দকারের প্রস্তাবই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে একে খন্দকারকে জানানো হয়, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনে ভারতীয়রা সম্মত হয়েছেন। তারা বাংলাদেশ সরকারকে একটি অটার বিমান, একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার এবং একটি ডিসি-৩ ডাকোটা (সি-৪৭) বিমান হস্তান্তর করে। ভারতের দেওয়া বিমান তিনটি যুদ্ধবিমান ছিল না। এগুলো ছিল মূলত বেসামরিক বিমান। যাই হোক, এ তিনটি বেসামরিক এয়ারক্রাফটকে অনেক কষ্ট করে কারিগরি বুদ্ধি খাটিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়। সেসব কারিগরি বিষয় এ লেখার স্থানের স্বল্পতাহেতু উল্লেখ করা সম্ভব হলো না। ওদিকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ উড্ডয়ন প্রশিক্ষণের জন্য নাগাল্যান্ড প্রদেশের ডিমাপুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য নির্মিত একটি পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ড ব্যবহার করতে দেয়। এয়ারফিল্ডটি ছিল গহিন জঙ্গল, উঁচু পাহাড় ও বৃক্ষ দিয়ে ঘেরা। এমন পরিবেশে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ ছিল খুবই বিপৎসংকুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে ৫ হাজার ফুটের একটি রানওয়ে এবং একটি কন্ট্রোল টাওয়ার ছিল। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এ গঠন প্রক্রিয়ার সময় প্রায় সব বৈমানিক বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধরত ছিল। পাকিস্তানিরা যাতে বুঝতে না পারে, তার জন্য যুদ্ধের ময়দান থেকে তাদের তুলে আনা হলো না। যারা তখন পর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানে যাননি, শুধু তাদের ডিমাপুরে একত্র করা হয়। তাদের সঙ্গে পিআইএ-এর বৈমানিকরাও এসে যোগ দেন। এসব বীর বৈমানিক হলেন-স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ বীর-উত্তম, ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট শামসুল আলম বীর-উত্তম, ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম বীর-উত্তম, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন বীর-উত্তম, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ বীর-উত্তম, ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন বীর-উত্তম, ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার বীরপ্রতীক, ক্যাপ্টেন খালেক বীরপ্রতীক এবং ক্যাপ্টেন মুকিত বীরপ্রতীক।
১৯৭১-এর ২৮ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবস্মরণীয় দিন। এদিন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জয়যাত্রা শুরু হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার বিমানবাহিনীর বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টন করে দেন। তিনি স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে এ নবগঠিত ফরমেশনের অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার এবং অটার বিমান নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বৈমানিকদের দুভাগে ভাগ করা হলো। হেলিকপ্টারের ক্যাপ্টেন হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয় স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে এবং কো-পাইলট হিসাবে নিয়োজিত হন ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম ও ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দিন। অটার বিমানের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম এবং কো-পাইলট হন ক্যাপ্টেন আকরাম ও ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন। অপরদিকে ডাকোটা বিমানের ক্যাপ্টেন নিয়োজিত হন ক্যাপ্টেন খালেক এবং কো-পাইলট হিসাবে নিযুক্ত হন ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার ও ক্যাপ্টেন মুকিত।
শুরু হলো কঠোর প্রশিক্ষণ। সব প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করে সকাল-বিকাল, এমনকি রাত্রিকালীন উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। বিশেষ করে রাত্রিকালীন প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়। কারণ, রাত্রিকালীন যুদ্ধপরিচালনায় পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার কথা বাংলাদেশি বৈমানিকরা ভালোভাবেই জানতেন। অতঃপর তাদের এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ঢাকাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় রাত্রিকালীন বিমান আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। এ লক্ষ্য অর্জনে দুর্ধর্ষ বীর বৈমানিকরা কঠোর পরিশ্রম করে তাদের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে থাকেন। প্রশিক্ষণের পনেরো দিন শেষে ডাকোটা বিমানকে আক্রমণ পরিকল্পনা থেকে বাদ দেওয়া হয়। কিছু যান্ত্রিক সমস্যার জন্য ডাকোটা বিমানটিকে যুদ্ধের অনুপযুক্ত মনে করা হয়। এ কারণে পরবর্তী সময়ে বিমান আক্রমণে ডাকোটা আর অংশগ্রহণ করেনি।
নভেম্বরের মাঝামাঝি ৬৬ দিনের প্রশিক্ষণ শেষ হলে বিমান আক্রমণের প্রথম পর্বে পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারি ও নারায়ণগঞ্জের জ্বালানি তেলের ডিপো ধ্বংসের পরিকল্পনা করা হয়। ঠিক হয় স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও তার কো-পাইলটরা হেলিকপ্টার নিয়ে নারায়ণগঞ্জ এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও তার কো-পাইলটরা অটার বিমান নিয়ে পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারির তেল ডিপোতে বিমান আক্রমণ করবেন। এ ঐতিহাসিক অপারেশনের নামকরণ করা হয় গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের নামের ইংরেজি প্রথম বর্ণ ‘কে’ অনুসারে ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট’। আক্রমণের তারিখ নির্ধারণ হয় ২৮ নভেম্বর। বৈমানিকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন আক্রমণের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য। কিন্তু এক অজানা কারণে ২৮ নভেম্বরের মিশন বাতিল হয়ে যায়। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে বিমান আক্রমণ শুরু করার পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পালটে যায়। পাকিস্তানি হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বার্তা আসে যে, সে রাতেই অপারেশন কিলো ফ্লাইট কার্যকর করা হবে।
৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পর্যাপ্ত জ্বালানি ও রকেট নিয়ে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ তার সঙ্গীসহ হেলিকপ্টার নিয়ে অপারেশনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হন। সন্ধ্যার পর তারা ভারতে তেলিয়ামুরা বিমানঘাঁটি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা দেন। রাতের অন্ধকারে হেলিকপ্টার দৃষ্টিগোচর না হলেও আওয়াজজনিত কারণে তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছিল। তেলিয়ামুরা থেকে কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ হয়ে ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়ক ধরে হেলিকপ্টার নায়ারণগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ডেমরায় পৌঁছে যায়। তারপর দক্ষিণে মোড় নিয়ে সোজা নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের তেলের ডিপো এলাকায় পৌঁছায়। রাতের অন্ধকারে হেলিকপ্টারের আওয়াজে সবাই চমকে ওঠে। এ সময় সুলতান মাহমুদ হেলিকপ্টার নিয়ে তেলের ডিপোর ওপর বেশ কয়েকবার চক্কর দিয়ে বেশ কয়েকটি রকেট নিক্ষেপ করেন। রকেট নিক্ষেপের পর বিকট শব্দে তা বিস্ফোরিত হয় এবং রাতের অন্ধকার ভেদ করে চারদিক আলোকিত করে তুলে। তাদের এ আচমকা হামলা পাকিস্তানিদের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। অতঃপর তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই সুলতান মাহমুদ ও তার দল তেলের ডিপোর ব্যাপক ক্ষতি করতে সক্ষম হন। অপারেশন সম্পন্ন করে তারা সহজেই পূর্বনির্ধারিত বিমানঘাঁটিতে ফিরে আসেন।
অপরদিকে, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম অটার বিমান নিয়ে সন্ধ্যা আটটায় তার দলবলসহ বাংলাদেশের শমশের নগরের উলটো পাশে ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাস শহর এয়ারফিল্ড থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা দেন। রওয়ানা হওয়ার পর অটার বিমান প্রথমে এক হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে শুরু করে। তারপর পাকিস্তানি রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য উচ্চতা কমাতে কমাতে একশ ফুটে নেমে আসে। রাতের অন্ধকারে নেভিগেশন সিস্টেম না থাকায় গন্তব্যের পথ ঠিক রাখার জন্য তিনি ফেনী নদী বরাবর অগ্রসর হতে থাকেন। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর শামসুল আলম বুঝতে পারেন তারা বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে গেছেন। তারপর বামে মোড় নিয়ে তেল শোধনাগারের দিকে অগ্রসর হন। কিছুদূর যাওয়ার পর চাঁদের আলোয় চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের রানওয়ে দেখতে পান এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই লক্ষ্যবস্তুর ওপর চলে আসেন। নিচে সারি সারি তেলের ট্যাংকার। শামসুল আলম আক্রমণের জন্য তৈরি হয়ে প্রথমেই তেলের ট্যাংকার বরাবর দুটো রকেট নিক্ষেপ করেন। রকেট দুটো তেলের ট্যাংকারে হিট করলেও বিস্ফোরণ হলো না। এভাবে তিনি দ্বিতীয়বারও চেষ্টা করেন। তৃতীয় আক্রমণের প্রস্তুতি নিতেই বিমানবন্দরের দুদিক থেকে শত্রুর ছয়টি বিমানবিধ্বংসী কামান গর্জে ওঠে। তবে বিমানে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি তৃতীয় আক্রমণ করেন। এবার রকেট ডিপোর মধ্যখানের একটি ট্যাংকে গিয়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। রকেট বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্যাংকটিতে ধাউ ধাউ করে আগুন ধরে যায়। অতঃপর এক ট্যাংকার থেকে আরেক ট্যাংকারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। শামসুল আলম পুরো অপারেশনে একে একে ১৪টি রকেট নিক্ষেপ করেন। আগুনের লেলিহান শিখা এত উচ্চতায় ওঠে যে, বহুদূর থেকেও সে আগুন দেখা যায়। শত্রুপক্ষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অপারেশন কিলো ফ্লাইটের যোদ্ধারা তেলের ডিপো এলাকা থেকে দূরে সরে আসেন। এবার তাদের ফিরে আসার পালা। লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানো কঠিন ছিল; কিন্তু ফেরত যাত্রা ছিল আরও কঠিন। লক্ষ্যবস্তু এলাকা থেকে প্রথমে অল্প উচ্চতায় উড়ে ধীরে ধীরে উচ্চতা বাড়ানো হয়। অবশেষে অতি সতর্কতার সঙ্গে দিক নির্ধারণ করে, সময় ও গতি বিবেচনায় রেখে কুম্ভীগ্রাম বিমানবন্দরে নিরাপদেই ফেরত আসেন। উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জ ও পতেঙ্গায় জ্বালানি তেলের ডিপো ধ্বংস হওয়ার ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশন ক্ষমতা অনেকাংশেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অপারেশন কিলো ফ্লাইটের যোদ্ধারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে ধারণ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে দেশপ্রেমের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। তাদের এ অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তবে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, পতেঙ্গার তেলের ডিপো ধ্বংসের নেতৃত্বদানকারী, অপারেশন কিলো ফ্লাইটের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম বীর-উত্তম, ৮ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৪৭ মিনিটে ৭৬ বছর বয়সে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। আমি আমার এ লেখার মাধ্যমে গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলমের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি। একই সঙ্গে বিজয়ের এ মাসে অপারেশন কিলো ফ্লাইটের প্রত্যেক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।