আগামী বছর আরও পাঁচ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন শিক্ষাক্রমে লেখা পাঠ্যবই দেওয়া হবে। বর্তমানে এসব বই লেখার কাজ চলছে। প্রাথমিক পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত হলে শুরু হবে বইগুলোর যৌক্তিক মূল্যায়ন। এরপরই চূড়ান্ত হবে পাণ্ডুলিপি। তবে হাতে যে সময় আছে, তাতে এবারও তড়িঘড়ি বই তৈরির কাজ সম্পন্নের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে যেসব লেখককে নিয়ে গত বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই রচনার কারণে বিতর্ক উঠেছিল, এবারও তাদের অধিকাংশকে একই কাজে রাখা হয়েছে। ফলে একইভাবে দেশীয় সমাজ-সংস্কৃতি আর সরকার ও আওয়ামী লীগের জনসম্পৃক্ততা বিবেচনায় না নিয়েই বইগুলো তৈরি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আর তেমনটি হলে আগামী বছরও নতুন পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতে পারে।
এদিকে আগামী বছর যথাসময়ে যাতে পাঠ্যবই মুদ্রণ কাজ শেষ হয় সেই লক্ষ্যে প্রক্রিয়া এখনই শুরু করা হয়েছে। এর অংশ হিসাবে ইতোমধ্যে প্রাথমিকের প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি এবং প্রাক-প্রাথমিক স্তরের দরপত্র নেওয়া হয়েছে। ৮ মে ষষ্ঠ এবং ১৫ মে সপ্তম শ্রেণির দরপত্র দাখিলের দিন ধার্য আছে। তবে অভিযোগ পাওয়া গেছে, অন্যান্য বছর মুদ্রাকররা সিন্ডিকেট করলেও এবার খোদ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কিছু কর্মকর্তা সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন।
এর অংশ হিসাবে তারা পাঠ্যবইয়ের প্রাক্কলিত দর বেশি নির্ধারণ করেছে। যেখানে প্রতি ফর্মা বইয়ের দর পৌনে ৩ টাকা হওয়া দরকার সেখানে ৩ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়েছে। পরে তারা মুদ্রাকরদের বেশি দর হাঁকানোর জন্য উৎসাহিত করে। যদিও প্রাথমিক স্তরে তারা সফল হয়নি। সর্বোচ্চ আড়াই টাকার মধ্যে মুদ্রাকররা এই স্তরের বইয়ের দর দিয়েছেন। কিন্তু এখন ওই চক্রটি মাধ্যমিকের বইয়ের দরপত্রে সিন্ডিকেট তৈরির চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যে কয়েক কর্মকর্তা গোপনে চিহ্নিত প্রকাশকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এতে তারা সফল হলে সরকারকে বেশি দরে বই ছাপাতে হবে। এনসিটিবির ওই সিন্ডিকেটে বিতরণ ও প্রশাসন শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। পাঠ্যবইয়ে সিন্ডিকেট নিয়ে কথা বলা যায়নি বিতরণ শাখার প্রধান লুৎফর রহমানের সঙ্গে। তবে নতুন পাঠ্যবইয়ের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনি বছর হওয়ায় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ বছর পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। আগামী বছর যেহেতু নির্বাচন থাকবে না, তাই কোনো বিতর্কও হবে না। এ বছর মুদ্রণজনিত ত্রুটি বাদে আর কোনো ভুল ছিল না। এরপরও নির্বাচন সামনে থাকায় সরকারকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিতর্কের সঙ্গে আপস করতে হয়েছে।
তবে ভিন্ন কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম. ওয়াহিদুজ্জামান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, একটি পাঠ্যবই রচনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা, সরকারের রাজনৈতিক দর্শন, জনসম্পৃক্ততা ও অনুভূতি ইত্যাদি বিবেচনায় নিতে হয়। আওয়ামী লীগের মতো জনসম্পৃক্ত ও গণতান্ত্রিক দলের রাজনৈতিক দর্শন এ দেশের মানুষের রুচি এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুভূতি ধারণ করেই নিবেদিত। কিন্তু নতুন পাঠ্যবইয়ে সেটি ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। মৌলবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে মৌলবাদকে প্রকারান্তরে উসকে দেওয়া হয়। বইয়ের পাঠ নির্বাচনেই শুধু নিুমান আর ভুলের পন্থা অনুসরণ করা হয়নি, উপস্থাপনায়ও শিক্ষাবিজ্ঞান আমলে নেওয়া হয়নি। মূলত রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের প্রতিফলন ঘটায় এমনটি হয়েছে। শিক্ষার দায়িত্ব প্রাপ্তরাই এরজন্য দায়ী।
নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে চলতি বছর প্রথম এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন বই দেওয়া হয়। এর মধ্যে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই নিয়ে ব্যাপক আপত্তি আর বিতর্ক উঠেছে। বিতর্কের মুখে দুটি বই প্রত্যাহার করে নেয় এনসিটিবি। এছাড়া অন্যান্য বইয়েও ভুলত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। ইতোমধ্যে পৌনে ৭শ ভুলের সংশোধনীও দেওয়া হয়েছে। এখন আগামী বছর আরও ৫টি শ্রেণিতে নতুন বই দেওয়ার কাজ চলছে। এর মধ্যে আছে প্রাক-প্রাথমিক স্তর। প্রথমবারের মতো আগামী বছর চার এবং পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের বই দেওয়া হবে। এতদিন প্রাক-প্রাথমিকে শুধু একটি শ্রেণি বা পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের বই দেওয়া হতো।
এছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণি। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই লেখার প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে তৃতীয় এবং অষ্টম শ্রেণির বই লেখার কাজ চলছে। অষ্টমের কাজ শেষ হলে নবম শ্রেণির বই লেখার কাজ শুরু হবে। প্রাথমিক পাণ্ডুলিপি তৈরি শেষ হলে এসব বইয়ের যৌক্তিক মূল্যায়ন করা হবে। তারপরই তা পাঠানো হবে মুদ্রণের জন্য প্রেসে।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জুনের মধ্যে প্রাথমিকের বই রচনার কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা আছে। আর অষ্টমের বই লেখার কাজ শেষ হবে ১৬ মে এবং নবম শ্রেণির কাজ শেষ করা হবে ৩০ জুনের মধ্যে। নিয়ম অনুযায়ী এরপর পাঠ অনুযায়ী ছবি বা চিত্রকর্ম নির্বাচন করা হবে। এগুলো শেষ বইয়ের খসড়া পাণ্ডুলিপি তৈরি করা হবে। এরপর তা বিষয়ভিত্তিক রিভিউয়ার বা যৌক্তিক মূল্যায়নকারীর কাছে পাঠানো হবে। সেটি শেষ হলে বই সংশোধন করা হবে। এরপর তা শিক্ষামন্ত্রীসহ নীতি-নির্ধারকদের কাছে উপস্থাপন করা হবে। তারা সংশোধনী দিলে সেই অনুসারে ফের বইয়ে পরিবর্তন আসবে। এই প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত খসড়া তৈরি হলে পাঠ্যবই মুদ্রণে পাঠানো হবে।
এসব বইয়ের কাজ তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, তারা জুলাইয়ের মধ্যে অষ্টম এবং আগস্টের মধ্যে নবম শ্রেণির চূড়ান্ত খসড়া তৈরির লক্ষ্য ঠিক করেছেন। আর অক্টোবরের মধ্যে বই মুদ্রণ শেষে স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত আছে। এখন খসড়া চূড়ান্ত করার কাজে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। আর প্রাথমিকের বইয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. একেএম রিয়াজুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, জুলাইয়ের মধ্যে বই চূড়ান্ত করে মুদ্রণে পাঠানোর সিদ্ধান্ত তাদের আছে।
ফের একই লেখক : এদিকে যেসব লেখককে নিয়ে বই লেখার কারণে এবার বিতর্ক উঠেছে তাদের অনেকেই অষ্টম-নবম শ্রেণির বই লেখকের তালিকায় আছেন। বিশেষ করে বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা বই নিয়ে বিতর্ক ছিল বেশি। স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইটির লেখক ছিলেন ১০ জন। তাদের মধ্যে ৫ জনকেই অষ্টম-নবম শ্রেণির বই লেখকের তালিকায় রাখা হয়েছে। বিজ্ঞান বইয়ের লেখক ছিলেন ৫ জন, যাদের মধ্যে ৩ জন এবারও আছেন। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির গণিত বইটির লেখক ছিলেন ৯ থেকে ১২ জন। তাদের মধ্যে ৬ জন আগের। নতুন প্যানেলে মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থী রাখা হয়েছে। এছাড়া গণিত অলিম্পিয়াড করা একটি বেসরকারি সংস্থার লোকও আছেন। ডিজিটাল প্রযুক্তি বইটির লেখক ছিলেন ৮ জন, যাদের মধ্যে ৬ জনই আগের। নতুন প্যানেলে মাস্টার্সের এক ছাত্র আছে।
এছাড়া বেসরকারি সংস্থার লোকও আছে। কিছু বইয়ে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক লেখকের আধিক্য দেখা যায়। আর যথারীতি ইউনিসেফসহ এনজিও ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা আছেন লেখকের তালিকায়। বাংলার মতো বিষয় লেখকের তালিকায় এমন একজনকে দেখা যায়। জানা গেছে, লেখকের এই তালিকা অনুমোদনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে এনসিটিবি। এ বিষয়ে অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, যারা উপযুক্ত লেখক তাদের নিয়েই প্যানেল করা হয়েছে।