ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধি-
চরভদ্রাসন বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার ছোট একটি উপজেলা।এই উপজেলার উত্তরে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলা ও ঢাকা জেলার দোহার উপজেলা, দক্ষিণে সদরপুর উপজেলা, পূর্বে ঢাকা জেলার দোহার উপজেলা, পশ্চিমে ফরিদপুর সদর উপজেলা ও নগরকান্দা উপজেলা অবস্থিত।
পদ্মা ও ভুবনেশ্বর নদী ঘেষে চরভদ্রাসন উপজেলাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আনুমানিক ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে চরসালেপুর নামক স্থানে চরভদ্রাসন থানা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
চরভদ্রাসন নামকরণ নিয়ে একাধিক গল্প বা কাহিনী প্রচলিত আছে। এলাকাটি ছিল পদ্মা নদীর চর। চাষাবাদ করে চরকে মনুষ্য বসবাসের করে তােলার জন্য তৎকালীন জমিদার কৃষি পেশার সাথে যুক্ত ভদ্র পদবিধারী কিছু মানুষকে এখানে নিয়ে আসেন। তারা খিল চরটাকে প্রচুর শ্রমে চাষাবাদ করে তােলে। ভদ্র সম্প্রদায়ের লােকজন চাষাবাদের মাধ্যমে চরটিকে শস্য শ্যামল করেছিলাে বলে চরটির নাম হয় চরভদ্রাসন। অনেকে মনে করেন, তখনকার বিখ্যাত ভদ্রা নদীর পলি জমে চরটি জেগে উঠেছিলাে। ভদ্রা নদীর চরে। এটি আসন গেড়েছিলাে বলে নাম হয় চরভদ্রাসন।
আরেক জনশ্রুতির মতে এ এলাকায় ব্রিটিশদের নিয়োজিত জমিদারের পেয়াদা ছিল মকিম মিয়া। স্বাধীনচেতা মকিম ছিল তিতুমীর এর ভাব স্বাগরেদ ছিল। তারই নির্দেশে জমিদারদের খাজনা না দেওয়ার জন্য উদ্ধৃত করেন। ফলে সংশ্লিষ্ট জমিদার মকিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। কয়েকদিনের মধ্যে শুরু হয় বন্দুক যুদ্ধ। মকিম মিয়া নিহত হয়। তার অন্যান্য অনুসারীদের দেশত্যাগ করতে বাধ্য করে। এসময় ব্রিটিশ সরকার এই এলাকায় একজন ব্রিটিশ ভদ্র লোককে দায়িত্ব দেন এলাকার শাসনভারের। পরবর্তীতে তার অনুগতদের চর পত্তন দেয়। কথিত মতে চরের মধ্যে একজন ভদ্র লোক (ঐ ব্রিটিশ নাগরিক) বসবাস করায় তখন এলাকার নাম করন করা হয় চরভদ্রাসন।
ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্র ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয়।পরবর্তীতে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে ‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০’ প্রবৃত্ত হলে জমিদারশ্রেণি বিলুপ্ত হয় এবং প্রজাদের কাছে জমি হস্তান্তর করা হয়। এলাকাটি ফরিদপুর জেলাধীন সদর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত থাকে। চরভদ্রাসন উপজেলার গোপালপুর সংলগ্ন খাসের হাটে পুলিশ স্টেশন তথা প্রশাসনিক কেন্দ্র বিন্দু ছিল। ১৯৫৪ সালে উক্ত এলাকা পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে ভেঙ্গে গেলে বর্তমানে স্থাপিত জায়গায় চরভদ্রাসন হাট প্রতিষ্ঠা হয়। তখন পুলিশ স্টেশন চরহাজিগঞ্জ স্থানান্তরিত হয়।ঐ সময়ের এমডিও জনাব এস,এম জয়নাল আবেদীন ১৯৬৮ সালে চরভদ্রাসন বাজারের উত্তর দক্ষিণে ইউটিডিসি প্রতিষ্ঠা করেন একই বছর চরভদ্রাসন আইয়ুব কলেজ যা বতমানে অবস্থিত চরভদ্রাসন পাইলট হাই স্কুলের একটি কক্ষ স্থাপন করেন। পরবর্তীতে চরভদ্রাসনে হেলথ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ সালে চরহাজিগঞ্জ থেকে পুলিশ স্টেশন স্থানান্তরিত হয়। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে চরভদ্রাসন থানা উপজেলার মর্যাদায় উন্নীত হয়।এরপর চরভদ্রাসনে একটি কলেজ ও প্রতিষ্ঠিত হয়।১ম উপজেলা চেয়রম্যান জনাব মো: আবুল হোসেন এবং ইউএনও জনাব মো: নরুল হুদা। বর্তমানে চরভদ্রাসন উপজেলায় সকল বিভাগের কাযক্রম চলছে।
চরভদ্রাসন উপজেলায় ৪টি ইউনিয়ন- চরভদ্রাসন ইউনিয়ন, চরহরিরামপুর ইউনিয়ন, গাজিরটেক ইউনিয়ন, চরঝাউকান্দা ইউনিয়ন। তবে পদ্মায় ভাঙ্গনের কারনে দুটি ইউনিয়নই আলাদা হয়ে গিয়েছে। এসব এলাকায় নৌ পথে যেতে হয়।
৯৭ টি গ্রাম রয়েছে এই উপজেলায়। এতিমখানা রয়েছে ১৯ টি, মসজিদ ২৭৪ টি, মন্দির ২৪টি, নদ-নদী ২ টি, হাট-বাজার ২০ টি, ব্যাংক শাখা ৬ টি, পোস্ট অফিস/সাব পোঃ অফিস ৩ টি রয়েছে এই উপজেলায়।
ছোট্ট এই উপজেলাটির মোট আয়তন হল ১৫৫ বর্গকিমি বা ৬০ বর্গমাইল। জনসংখ্য ৬৮,১৫২ জন (প্রায়) যার মধ্যে পুরুষ ৩৫,০০০ জন (প্রায়) এবং মহিলা ৩৩,১৫২ জন (প্রায়)। এই এলাকায় লোক সংখ্যার ঘনত্ব ১,২৩৯ (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে)।
চরাঞ্চলের এলাকা হলেও প্রচুর পরিমান বৈদেশিক রেমিটেন্স আসায় উপজেলাটির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। অন্যান্য উপজেলার চেয়ে চরভদ্রাসন উপজেলার শিক্ষার হার কম নয়। মোট শিক্ষার হার ৭৫%। উপজেলায় একটি সরকারি কলেজ একটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও বেশ কিছু হাইস্কুল রয়েছে। ইসলাম শেখার জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি ভালো মানের মাদ্রাসা। এলাকাবাসির দীর্ঘদিনের দাবী চরভদ্রাসনের সবচেয়ে পুরাতন হাইস্কুল- চরভদ্রাসন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়টির সরকারিকরনের।তাহলে উপজেলার হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী সরকারি শিক্ষার সুযোগ-সুভিদা পাবে।
রুপালি ইলিশের জন্য এই উপজেলাটি বিখ্যাত। সারাবছরই এই উপজেলার পদ্মা নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়। এছাড়া এই পদ্মা নদীতে বড় কাতলা,রুই,পাঙ্গাস,চিংড়িসহ সব ধরনের মাছ পাওয়া যায়। লোক মুখে বলতে শোনা যায় যে দেশের সবচেয়ে স্বাদের মাছ এই পদ্মা নদীতে পাওয়া যায়। ছোট বড় প্রায় ২ হাজার জেলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে।
কৃষিতে পিছিয়ে নেই এই উপজেলা ,পাট ও পেয়াজ চাষে এলাকাটি বিখ্যাত। এছাড়া,ধান,গম,ভুট্টা, সড়িষা,মশুড়ি ও এই এলাকায় চাষ হয়। উক্ত এলাকার আয়ের দিক থেকে প্রবাসিদের পরেই কৃষকদের স্থান।
শীতের সময় এই অঞ্চলে পিঠাপুলির উৎসবে মেতে উঠে লোকজন। খেজুরের গুড়ের জন্য সারাদেশে এই এলাকাটি বিখ্যাত ছিল। কিন্তু গাছ-পলা কেটে বসত বাড়ি নির্মান করায় এখন এই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। বলা হয় একসময় এই এলাকার প্রত্যেক বাড়িতে ৮/১০ টা করে খেজুর গাছ ছিল।
ছোট-বড় প্রায় ২০ টি বাজার আছে এই উপজেলায়। তবে সবচেয়ে বড় বাজার দুটি একটি চরভদ্রাসন বাজার আর অন্যটি হাজীগঞ্জ বাজার।বাজার গুলোতে সপ্তাহে দুদিন হাট বসে।দুরদুরান্ত থেকে এই হাটে পেয়াজ,রসুন,গরু,ছাগল কেনার জন্য ব্যাপাররা আসে।এছাড়া সব ধরনের মাছ-মাংস ও সবজি,শস্য এই হাট-বাজারগুলোতে পাওয়া যায়।
উপজেলার গোপলপুর ফেরী ঘাট হলো একমাত্র বানিজ্যিক ঘাট।এই ঘাট দিয়েই দ্রুত সময়ে ঢাকা সহ দেশের যে কোন অঞ্চলে যাওয়া হয়। মাত্র পনেরো মিনিটে ঢাকার দোহার উপজেলায় পৌছানো যায় এই ঘাট দিয়ে। তবে এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি এই ঘাটে ফেরী চালু হলে যাতায়ত ব্যাবস্থা আরো উন্নত হবে। এছাড়া এই পদ্মার ওপারে মইনুট ঘাটটি ভ্রমন পিপাসুদের জন্য নজর কেড়েছে।এই ঘাটটিকে মানুষ এখন মিনি কক্সবাজার বলে জানে।
দেখার মত এই উপজেলায় মিনি কক্সবাজার,গোপালপুর ঘাট,এমপি ডাঙ্গী নদীর পার,স্বাধীনতা চত্তর,তোতা হাজী মসজিদ সহ চরাঞ্চল খুব জনপ্রীয়।আপনি চির সবুজে হারিয়ে যেতে চাইলে চরভদ্রাসন উপজেলার চর হরিরামপুর,চর শালেপুর,হাজারবিঘা চরে ঘুড়ে আসতে পারেন।
প্রাচীনকাল থেকেই এই জনগাষ্ঠী ক্রীড়ামোদী। এখানে প্রতিবছরই বিভিন্ন টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। এখানকার জনপ্রিয় খেলার মধ্যে বর্তমানে ক্রিকেট ও ফুটবলের আধিপত্য দেখা গেলেও অন্যান্য খেলা যেমন: ভলিবল, দাড়িয়া বান্দা, গোল্লাছুট, মৌমাছি, বৌছি, হাডুডু, লাঠিখেলায় পিছিয়ে নেই। বেশ কয়েকটি খেলার মাঠ রয়েছে। এর মধ্যে চরভদ্রাসন সরকারি কলেজ মাঠ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। প্রতি বছর এ মাঠে ফুটবল,ক্রিকেট প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
চিকিৎসা সেবার জন্য এই উপজেলায় রয়েছে একমাত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।এছাড়া কয়েকটা নামমাত্র কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। তবে চিকিৎসক সংকটে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তেমন কোন সেবা পাওয়া যায়না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। সামান্য কাটা-ছেড়ার সেবারজন্যও যেতে হয়ে জেলা শহরে।
নদী মাতৃক দেশে নদী ভাঙ্গনই এই এলাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা। প্রতি বছর পদ্মায় বসতভিটে হারায় শত শত পরিবার। তবে বর্তমান সরকারের আমলে প্রায় তিনশত কোটি টাকা ব্যায়ে এই এলাকার পদ্মা নদীর পাড়ে স্থায়ী বাধ তৈরী হয়েছে। এতে নদী ভাঙ্গন অনেকটাই হ্রাস পাবে বলে ধারনা করছেন এলাকাবাসী।
মাছে-ভাতে বাঙ্গালী অর্থাৎ এই এলাকার মানুষের ও প্রীয় খাবার মাছ ভাত।এছাড়া গরু ও খাসীর মাংস এ এলাকার মানুষের প্রীয় খাবার। প্রায় সারা বছরই বিভিন্ন রকম পিঠা খেতে পছন্দ করেন চরভদ্রাসনের মানুষ।
বিখ্যাত ব্যাক্তিদের মধ্যে কুটি মন্সুর-পল্লি গীতির গায়ক,আলহাজ্জ আব্দুল আওয়াল মৌলভী -ওলীআল্লাহ,আলহাজ্জ তাবলীগ আমীর ডাঃ মোঃ শাহজাহান আক্তারুজ্জামান -ওলীআল্লাহ, আলহাজ্জ মোঃ আবুল কালাম মোল্যা -পীর সাহেব, আজাহার উদ্দিন মেল্যা - শিক্ষাবিদ প্রমূখ রয়েছেন এই উপজেলায়
।অন্যান্য অঞ্চলের থেকে এই এলাকার মানুষ ভদ্র এবং শৌখিনও বটে। অবসর সময়ে খেলাধুলা ও ভ্রমন পছন্দ করেন এই এলাকার মানুষ। একে অপরের বিপদেও এগিয়ে যান সহযে।