প্রহলাদ মন্ডল সৈকত, রাজারহাট(কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধিঃ
‘কাল রাতোত তিস্তা নদীর চাপা এমন করি ভাঙি পড়লো, নিন(ঘুম) থাকি জাগি দ্যাখং মোর বাড়ির আগিনা (আঙিনা) নদীত চলি গ্যাছে’ শনিবার(৭অক্টোবর) দুপুরে কথাগুলো বলছিলেন আলেমা বেগম (৫০)। তিনি কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের রামহরি এলাকার হাফিজুর রহমানের স্ত্রী। তার জীবনে ৫-৬ বার তিস্তার ভাঙনে স্বামীর ভিটেমাটি হারিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, আমার বিয়ে হওয়ার পর থেকে ৫-৬ বার তিস্তার ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছি আমরা। যখনি একটু সংসারটা গোছাতে শুরু করি, তখনি তিস্তার ভাঙনে শেষ হয়ে যায় সব। এক সপ্তাহ ধরে স্বামী সন্তান নিয়ে এক প্রতিবেশির বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আছি। এখন কোথায় যাবো, কি করবো চিন্তা করে কুল কিনারা পাই না।
শুধু রামহরি এলাকার আলেমা বেগম নন, তার মতো অনেকে তিস্তার ভাঙনে বাব দাদার ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। আবার ভিটেমাটি হারানো কেউ কেউ চুক্তি ভিত্তিতে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব পরিবারের মাথাগোঁজার ঠাঁই না থাকার কারণে নিয়তিই তাদের একমাত্র ভরসা।
রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের রামহরি এলাকার রহিম মিয়া, সিদ্দিক, সিরাজুল, হায়দার, রহমত, রফিক বলেন, আমাদেরও কয়েকদিন আগে ভিটেমাটি তিস্তা নদীতে চলে গেছে। যাওয়ার মতো কোন স্থান নাই। মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আছি। বউ বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাবো, কি করবো চিন্তায় বাঁচি না। কি যে হবে আল্লাহ পাক ছাড়া কেউ জানে না।
জানা গেছে, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেলেও ভাঙছে, পানি কমলেও ভাঙছে। যার ফলে গত তিনদিনে তিস্তার অববাহিকার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের প্রায় ২৫-৩০টি পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। এর মধ্যে যাদের জায়গা জমিন নেই। তারা অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এছাড়াও ওই ইউনিয়নে হুমকির মুখে রয়েছে কালির মেলা বাজার, কালির মেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রামহরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সোনার জুম্মা, কালির মেলা এবতেদায়ী মাদরাসাসহ অনেক বাড়ি ঘর ও ফসলি জমি। এর আগেও শুধু রাজারহাট উপজেলার তিস্তা নদীর অববাহিকার বিভিন্ন এলাকায় শত শত পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছেন।
রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের ১নং ওর্য়াডের ইউপি সদস্য মোঃ আব্দুল বাতেন বলেন, গত তিনদিনে আমার ওর্য়াডের ২৫টির মতো বাড়ি ভেঙেছে। এর মধ্যে ১০-১২ জনের অবস্থা খুব খারাপ। নিজেদের জায়গা জমি না থাকার কারণে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমরা তাদের বলেছি আমন ধান কাটা শেষ হলে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে।আমার এলাকার রামহরি ও কালির মেলা এলাকায় এখনো ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।
রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, কুড়িগ্রামে গত ২৪ ঘন্টায় ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা আগামী ৮ অক্টোবর পর্যন্ত থেমে থেমে অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাবেরী রায় বলেন, আমি অল্পকিছু দিন হয় এই উপজেলায় এসেছি। তিস্তা তো সবসময় ভাঙে। তবে এবার যে পানিটা আসতেছে ভারত থেকে খুব ঘন ও কাদা যুক্ত। এ কারণেই ভাঙন বেশি হতে পারে। আর নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা এখনো পাইনি।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, বর্তমানে তিস্তা নদীর ১০টি পয়েন্টে ভাঙন চলছে। এর মধ্যে কালির মেলা ও রামহরি এলাকায় ভাঙন বেশি। আমরা জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধে কাজ করছি। সমস্যা হচ্ছে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেলেও ভাঙছে, পানি কমলেও ভাঙছে।