এস,এম শাহাদৎ হোসাইন, গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক না হলেও নির্বাচনী আমেজে সরগরম পুরো গাইবান্ধার সংসদীয় আসন গোবিন্দগঞ্জ। উপজেলার পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান থেকে খেলার মাঠ, আড্ডা, সবখানে আলোচনার বিষয় একটাই আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে গোবিন্দগঞ্জে কে পাচ্ছে কোন দলের মনোনয়ন, এর হিসাব কষছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
সারা দেশের মতো মনোনয়ন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের নেই গাইবান্ধা-৪ গোবিন্দগঞ্জ সংসদীয় আসনের ভোটারদের। ভোটারদের মন জয় করতে শুরু হয়েছে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তৎপরতা। উন্নয়নের বার্তা নিয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে হাজির হচ্ছেন টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মনোনয়ন দৌড়ে কে এগিয়ে, তা নিয়েও চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। গাইবান্ধা-৪ সংসদীয় আসনের মহিমাগঞ্জ, কাটাবাড়ী, কোচাশহর, নাকাই, রাজাহারসহ ১৭টি ইউনিয়নের সব কটিতেই আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো।
দলের জ্যেষ্ঠ নেতা এবং মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নিজস্ব চেম্বারে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ভিড়। উঠান বৈঠক, মতবিনিময় সভার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। আওয়ামী লীগের এত সব আয়োজনের বিপরীতে মাঠে নেই বিএনপি প্রার্থী ও নেতারা। তবে বিএনপির নেতাগণ বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি না সে ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত না হলেও রাজপথের আন্দোলন জোরদারের মাধ্যমে দাবি আদায় করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে ভাবছেন না তারা। তাদের টার্গেট সরকারকে হটিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের এক দফা দাবি আদায়ে কঠোর কর্মসূচির পথে হাঁটছে জাতীয়তাবাদী আদর্শের রাজনৈতিক দলটি।
এদিকে জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতৃত্ব নিয়ে চলছে টানাপড়েন। এ ছাড়াও দলটির দুই শীর্ষ নেতা রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদের ঐক্যে ফাটল ধরায় জাপার জেলা নেতৃত্বেও এর প্রভাব পড়েছে। মূল দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনগুলোকে শক্ত ভিত দিতে তৎপর দলটি। দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের হাতে আগামী দিনের হাল তুলে দিতে চায় জাপা। এমনটি জানিয়েছেন দলটির জেলা নেতারা।
অন্যদিকে গোবিন্দগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর দৃশ্যমান কোনো সাংগঠনিক কর্মকান্ড না থাকলেও ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছে দলটি। বিএনপির সঙ্গে স¤পর্কের টানাপড়েন ও রাজনৈতিক কৌশলের কারণে এবার এককভাবে নির্বাচন করতে চায় জামায়াত। সে লক্ষ্যেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। ইতিমধ্যে এ আসনে নিজেদের একক প্রার্থী ঠিক করেছে জামায়াতে ইসলামী।
গোবিন্দগঞ্জ আসনে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির, ২০০১ সালে বিএনপির ও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী বর্তমান সংসদ সদস্য প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন চৌধুরী ও সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ।
এ ছাড়াও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ প্রধান, সাধারণ স¤পাদক মোকাদ্দেস আলী বাদু, সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট ইবনে আজিজ মো. নুরুল হুদা, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা নাজমুল ইসলাম লিটন, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক স¤পাদক ও গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র আতাউর রহমান সরকার মনোনয়ন চাইবেন। গোবিন্দগঞ্জে আওয়ামী লীগে বিভক্তি সবচেয়ে বড় সমস্যা।
এ আসনে যিনিই মনোনয়ন পাবেন তাকেই দলের একাংশের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে। সে কারণে জয়ের জন্য দলের পর্যাপ্ত ভোট এ এলাকায় থাকলেও প্রার্থীর পরাজয়ের শঙ্কা সবসময় থেকেই যায়। যদিও মনোনয়নপ্রত্যাশী সবাই মুখে দলীয়প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকেই মনোনয়ন দেবেন তার পক্ষেই সবাই কাজ করবেন। বর্তমান সংসদ সদস্য মনোয়ার হোসেন চৌধুরী এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী থাকাকালীন এবং পরবর্তীকালে ২০০৮ এবং ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এলাকার যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে ভোটার ও দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার দূরত্ব বেড়ে গেছে। অন্যদিকে ২০০৪ সালে গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন জাসদ নেতা আবুল কালাম আজাদ। ২০০৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ২০০৮ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৬ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন আবুল কালাম আজাদ। আবুল কালাম আজাদ শক্তভাবে জামায়াত-শিবিরের অপতৎপরতা মোকাবিলা করে অনেকের সমর্থন পেলেও আদিবাসী সাঁওতালদের উপর নিপীড়নের ঘটনায় নেতৃত্বদানের অভিযোগে তিনি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হন। গাইবান্ধা-৪ আসনে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ প্রধান ব্যাপক গণসংযোগ চালিয়ে আলোচনায় এসেছেন।
গাইবান্ধার পাঁচটি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগে কোনো বিভক্তি বা গ্রুপিং নেই দাবি করে জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর স¤পাদক সাইফুল আলম সাকা বলেন, আওয়ামী লীগ একটি নির্বাচনমুখী বড় রাজনৈতিক দল। নির্বাচনে অংশ নিতে যেমন অনেকেই আগ্রহী থাকেন। তেমনি নেতৃত্বের প্রতিযোগিতাও থাকে। তবে তা দলে বিভক্তি হিসেবে কাজ করে না।
নির্বাচনের সময় কখনো কখনো একাধিক প্রার্থী হলে তার পক্ষ-বিপক্ষে কর্মীরা ভাগ হয়ে পড়ে। এ দ্বন্দ্ব বা বিভক্তিকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিভক্তি বা গ্রুপিং হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। স্বচ্ছ ও সদৃঢ় সাংগঠনিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে জেলা আওয়ামী লীগ। গাইবান্ধা-৪ আসনে ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মোত্তালিব আকন্দ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০৫ সালে তার মৃত্যুতে এ আসনের উপ নির্বাচনে মোত্তালিব আকন্দের বড় ছেলে শামীম কায়ছার লিংকন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ছিলেন ফারুক কবির আহমেদ। কিন্তু নির্বাচনের কয়েক দিন আগে মনোনয়ন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের হলে প্রার্থিতা হারান ফারুক কবির আহমেদ।
এখন বিএনপি রাজপথের আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তাদের মূল ভাবনায় আন্দোলন থাকলেও নির্বাচনের প্রস্তুতিও যে একেবারে নেই তা বলা যাবে না। এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা না থাকলেও চলছে নির্বাচনি হোমওয়ার্ক। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন, সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শামীম কায়ছার লিংকন, উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ স¤পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক কবির আহমেদ, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম, উপজেলা বিএনপি আহ্বায়ক ফারুক আহম্মেদ, আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এ্যাড. ওবাইদুল হক সরকার বাবলু ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক রবিউল কবীর মনু। জেলা বিএনপির সাধারণ স¤পাদক মাহামুদুন নবী টিটুল বলেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে গাইবান্ধায় বিএনপি অনেক বেশি সংগঠিত। দলে কোনো বিভেদ- কোন্দল নেই।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দলের পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। দাবি-দাওয়া আদায়ে রাজপথের আন্দোলনের বিকল্প নেই। শিগগিরই দলের করণীয় ও অবস্থান স¤পর্কে জানা যাবে। দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত আপাতত নেই বিএনপির।
আগামী নির্বাচনে গাইবান্ধা-৪ আসনে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও উপজেলা শাখার আহ্বায়ক কাজী মশিউর রহমান দলের মনোনয়ন চাইবেন। জাতীয় পার্টি জেলা কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ও জাতীয় শ্রমিক পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ বিষয়ক স¤পাদক রেজাউন্নবী রাজু বলেন, জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভক্তি নেই।
পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্বে দলটি এখন ঐক্যবদ্ধ। পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দলকে আরও শক্তিশালী করতে কাজ করে যাচ্ছে। গাইবান্ধা-৪ আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে দলটির রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চল টিমের সদস্য ডা. আব্দুর রহিম সরকারের নাম শোনা যাচ্ছে।
গাইবান্ধার সবচেয়ে বড় উপজেলা গোবিন্দগঞ্জের ১৭টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গাইবান্ধা-৪ সংসদীয় আসন। এ আসনে ভোটার রয়েছে ৪ লক্ষ ৮১ হাজার ২৬২ জন। তার মধ্যে পুরুষ ২ লক্ষ ৪১ হাজার ৬৭২ জন ও নারী ২ লক্ষ ৩৯ হাজার ৫৮৪ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ৬ জন।