গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি:
দেশ স্বাধীনের পর থেকে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক নেতা, ধমীয় নেতাগণ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতার বদ্ধির জন্য কাজ করলেও এখনো সাধারণ মানুষ মেয়েদের পরিবারের বোঝা মনে করায় বাল্যবিবাহের প্রবণতা কমানো যাচ্ছে না। প্রশাসন নানা উদ্যোগ নিলেও বাল্যবিয়ে বন্ধে অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য নয়।
বিশেষজ্ঞগণ বলেন,আইনের যথাযথ প্রয়োগ করলে বাল্যবিবাহের হার কমিয়ে আনা যাবে। রংপুর নগরীর এরশাদ নগর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করে ইতি (১৫) নামে এক কিশোরী। যে বয়সে লেখাপড়া ও বন্ধুদের সঙ্গে হেসে-খেলে বেড়ানোর কথা, সেই বয়সে দেড় বছরের সন্তানসহ স্বামীর সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
১২ বছর বয়সে বিবাহ হওয়ায় এখন ইতির জীবন অনেকটাই টালমাটাল। ইতি, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মনিরা, ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মল্লিকা কিংবা স্বামী পরিত্যক্তা টু¤পাদের মতো অনেককেই বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বেসরকারী চাকুরীজীবি আব্দুল হালিম বলেন, সামাজিক অসচেতনতার, অভিভাবকদের শিক্ষার অভাব ও দারিদ্রোতার কারণে পরিবারে মেয়েদের বোঝা মনে করা হচ্ছে। যে কারণে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করার পরও বাল্যবিবাহ কমছে না।
ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বাল্যবিবাহ হয় বেশি। যে মেয়ের বাল্যবিবাহ হয় সে উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ করতে গিয়ে স্বাস্থ্যহানি ঘটে, এমনকি মৃত্যুও ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাচ্চাসহ কম বয়সে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। ওই মেয়ে তখন নিজের সংসার চালাতে গিয়ে নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়। দর্শনা বাছিরন নেছা বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন ইতি। তিন বছর আগে বিবাহ হয়। দরিদ্র বাবা-মায়ের কন্যাদায় থেকে মুক্তির জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার করণে ইতির জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। বিবাহের তিন বছর না যেতেই দুই সন্তানের মা হয়েছে। ভ্যান চালক স্বামীকে নিয়ে ইতি এখন এরশাদ নগরের একটি ভাড়া বাসায় থাকে। হতাশা কন্ঠে ইতি বলেন, বাড়িঘর দেখে নাই, অন্য কিছু দেখে নাই। বিয়া দিয়াই মনে হয় রেহাই পাইছে। বাবা-মায়ের দোষ দিয়ে লাভ নাই, আমার ভাগ্যে ছিল। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মনিরা ১৪ বছর বয়সে ৬ মাস বয়সি এক শিশুর মা হয়েছে। যদিও পৃথিবীর মারপ্যাঁচ কিছুই বুঝে না মনিরা।
রংপুর আশরতপুর বস্তিতে মনিরার বাবার বাড়িতে দেখা যায়, কোলে সন্তান রয়েছে। কোলের সন্তান কিছুক্ষণ পরপর কাঁদলেও সেদিকে তেমন কোনো মনোযোগ নেই তার। একটু পর পর অকারণে হাসছে মনিরা। কথা বলার চেষ্টা করলেও মনিরা শুধু হাসি ছাড়া আর কোনো কথা বলতে পারেনি। মনিরার মা মঞ্জু বেগম বলেন, মেয়েটা কিছু বুঝে না। ওই জন্য খুব চিন্তায় ছিলাম। দেড় বছর আগে পাশের বস্তির এক ছেলের সাথে বিয়ে দিই। বিয়ের পর মেয়েটা মাত্র একমাস ছিল শ্বশুর বাড়িতে। এখন একটা বাচ্চা হইছে। ওর শ্বশুর বাড়ির লোকজন কোনো খোঁজ খবর নেয় না। জামাই আর আসে না। মনিরার বাবা কাশেম মিয়া বলেন, আমরা গরিব মানুষ। অল্প বয়সে বেটিকে বিয়ে দিতে পারলে বাঁচি। কিন্তু আমার অবুঝ মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে চিন্তা আরও বেড়ে গেছে। এখন বুঝতেছি কত বড় ভুল হয়েছে। এ ভুল সারাজীবনেও শোধরাতে পারবো না।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএ এর সবশেষ প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। সংস্থাটির ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, বয়স ১৮ হওয়ার আগেই বাংলাদেশে ৫১ শতাংশ মেয়ের বিবাহ হয়ে যাচ্ছে। ১৫ বছর বা তার কম বয়সি মেয়ের ক্ষেত্রে এই হার ২৭ শতাংশ।
গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর চরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলের ছেলে-মেয়েদেও বাল্যবিবাহ দেওয়া হচ্ছে। ফলে অপুষ্টিত্ব নিয়ে শিশু জন্ম গ্রহণ করছে। বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। নাম প্রকাশের অইচ্ছুক এক এ্যাডভোকেট বলেন, বাল্যবিয়ে বন্ধে আইন করা হয়েছে। এরপরও বাল্যবিয়ে বন্ধ হয়নি।
সবশেষ ২০১৭ সালে নতুন করে বাল্যবিবাহ বন্ধের আইন পাস করা হয়। এ আইনে তৃণমূল পর্যায় থেকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠনের বিধান রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের কিছু সরকারি কর্মকর্তাকে বাল্যবিবাহ বন্ধের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টগণ নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে বাল্যবিবাহ সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ছাড়াও বাল্যবিবাহ করলে যেসব শাস্তির বিধান রয়েছে, তা প্রয়োগ তেমন দেখা যায় না। বাল্যবিবাহ বন্ধে জনসচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনই আইনের প্রয়োগও করতে হবে। প্রচলিত আইনে যেসব সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না তার প্রমাণ এখনও বাল্যবিবাহ হচ্ছে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রংপুর বিভাগে ১৮ বছরের নিচে বিবাহ হয় অন্তত ৬৪.৮ ভাগ কন্যা সন্তানের। আর ১৫ বছরের নিচে বিবাহ হয়ে যায় ১৬.৮ শতাংশের। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ সংগঠিত হয় শহরের বস্তি এলাকা আর চরাঞ্চলগুলোতে। দারিদ্র্যতা, শিক্ষা অভাব, নারীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দূর করাসহ সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ সংস্থাটির। আরডিআরএস বাংলাদেশ এর কো-অর্ডিনেটর শমসেয়ারা বিলকিস বলেন, সারাদেশের মধ্যে উত্তরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হচ্ছে। শুধু যে দরিদ্র বা অল্পশিক্ষিত পরিবারে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে তা নয়। এমনকি শহরে অনেক শিক্ষিত পরিবারেও বাল্যবিবাহ হচ্ছে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুকেমুজান্নাতুন নেছা মমু বলেন, বাল্যবিবাহের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা, অপরিণত গর্ভধারণ, মাতৃমৃত্যু ঝুঁকি, প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যুঝুঁকি, প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মা ও শিশুর মৃত্যু হার শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন এ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। প্রতিটি শিশুর সুস্থ স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করার জন্য বাল্যবিবাহ বন্ধে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবিএম নুরুল্লাহ। তিনি বলেন, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূলের যে লক্ষ্যমাত্রা, সেটি শতভাগ পূরণ করতে হলে সরকারকে আরও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।