উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি:
নড়াইলে বসে আমেরিকার পাইলট সেজে প্রেমের ফাঁদ বেনজিরের পকেটে অর্ধশত নারীর শতকোটি আত্মসাৎ। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের হাতে আটককৃত নড়াইল মির্জাপুর গ্রামের চিহ্নিত ডিজিটাল প্রতারক চক্রের প্রধান, নীল ছবির নায়ক, ফেসবুক ও ইমো হ্যাকার বেনজির আহমেদ।
উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি জানান, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ঢাকা’র প্রধান মোঃ আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে নড়াইলের সদর উপজেলার মির্জাপুরের প্রতারক বেনজীর আহমেদকে গত ২১ নভেম্বর আটক করা হয়। আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেনকাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ঢাকা’র প্রধান মোঃ আসাদুজ্জামান, তিনি জানান, আটককৃত প্রতারক বেনজীর আহমেদ নড়াইল সদর উপজেলার বিছালী ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের জামির মোল্যা’র ছেলে।
প্রতারক বেনজীর আহমেদকে আটকের পর নড়াইলে’র মির্জাপুর গ্রামের সাধারণ জনগণ আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেন। এসময় প্রশাসনের কাছে প্রতারক বেনজীর আহমেদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন নড়াইলবাসী।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রায় অর্ধশত নারীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নড়াইলের বেনজির হোসেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক আমেরিকান পাইলটের ফেসবুক আইডি নকল করে পাঁচ বছর ধরে ‘রোমান্স স্ক্যাম’ করে তার সম্পদ গড়ার তথ্য পেয়েছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ।
সিটিটিসি বলছে, বেনজিরের ফেসবুকে ভুয়া জৌলুসপূর্ণ প্রোফাইল তৈরি করে এই প্রতারক নিঃসঙ্গ নারী, সিঙ্গেল মাদারদের টার্গেট করে প্রথমে প্রেমের ফাঁদে ফেলেন। পরে বিয়ে ও সপরিবারে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার প্রলোভনে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিলেন বছরের পর বছর ধরে। প্রথমে বিশ্বাস তৈরি করে, সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই প্রতারক।
বেনজিরকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে গতকাল সোমবার এসব তথ্য জানান সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, শাহিদ হাসান নামে আমেরিকা প্রবাসী এক বাংলাদেশি বিমান চালকের প্রোফাইল হুবহু কপি করে একটি ভুয়া ফেসবুক প্রোফাইল তৈরি করেন বেনজির। প্রোফাইলটিকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তিনি নিয়মিত শাহিদ হাসানের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে বিমান চালানোর ছবি ও ভিডিও পোস্ট করতেন। প্রতারক বেনজির ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ এবং পেজে নিঃসঙ্গ নারী ভিকটিমদের টার্গেট করে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করে প্রথমে প্রেমের ফাঁদ ফেলেন, পরে বিয়ের প্রলোভন ও সপরিবারে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। তিনি অডিও কলে ভিকটিমদের সঙ্গে কথা বললেও কখনোই ভিডিও কলে কথা বলতেন না। প্রণয়ের একপর্যায়ে বিভিন্ন সময় বিপদে পড়ার কথা বলে তার দেওয়া বিভিন্ন নগদ নম্বরে (প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা ১৯টি নগদ নম্বরের বিষয়ে জানা গেছে) ধাপে ধাপে লাখ লাখ টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেন।
বেনজিরের বাড়ি নড়াইলে হলেও প্রতারণার টাকা ক্যাশ আউট করতেন বাড়ি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে যশোর ও খুলনার বিভিন্ন নগদ ক্যাশ আউট পয়েন্টে। তার প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত সিম ও নগদ নম্বরের রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত এনআইডি অন্য ব্যক্তির নামে। ক্যাশ আউট করার সময় প্রতারক বেনজির পরিচয় ও চেহারা গোপন করার জন্য ক্যাপ, সানগ্লাস ও মুখে মাস্ক পরে থাকতেন।
ছয় মাসে এক সিঙ্গেল মাদার প্রায় এক কোটি টাকা খুইয়েছেন বলে জানিয়েছে সিটিটিসি। আসাদুজ্জামান জানান, বেনজিরের ফাঁদে পড়ে ওই নারী ১ কোটি টাকা হারিয়েছেন। অন্য এক নারী দিয়েছেন ১৫ লাখ টাকা। এমন ৫০ জন ভুক্তভোগী নারীর তথ্য পাওয়া গেছে। আরও অসংখ্য নারীর তথ্য মুছে ফেলেছে বেনজির। প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন এজেন্ট নম্বর থেকে গড়ে ১৫-২০ লাখ করে টাকা উত্তোলন করতেন তিনি।
বেনজিরের সম্পদের পাহাড়: দৃশ্যমান আয়ের উৎস না থাকলেও নড়াইলে ৫ বিঘা জমির ওপর বাগানবাড়ি (২ তলা ডুপ্লেক্স ভবন), অনুমানিক ৩ বিঘা জমির ওপর সম্প্রতি কেনা বিলাসবহুল ভবন, নড়াইলে বিভিন্ন জায়গায় অনুমানিক ২০ বিঘা মাছের খামার, নড়াইলে বিভিন্ন স্থানে নির্মিত ভবন; যশোর, সাভারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বহুতল ভবন, ব্যাংক ব্যালেন্স থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে মো. আসাদুজ্জামান জানান, বেনজির এইচএসসি পাস করে একটা চাকরিতে যোগ দেন। চুরির দায়ে সেই চাকরি চলে যায়। তিনি খুবই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার বাবা ওই অঞ্চলের বিভিন্ন হাটবাজারে তালের শাঁস বিক্রি করতেন। তবে বেনজির খুব মেধাবী ছিলেন। তার বৈধ কোনো পেশা নেই।