মোঃ ফিরোজ ফরাজী, রাঙাবালী (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি :
মান্তা শিশুদের চোখের জলে বিদায় ভাসমান স্কুল।
নদী পাড়ের কাদাপানিতে নেমে অঝোরে কাঁদছিল একদল শিশু। কোনো সান্ত্বনাতেই থামছিল না তারা। সান্ত্বনা দিতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না মা-বাবারাও। তাদের এমন কান্না শুধু প্রিয় ভাসমান স্কুলের জন্য। যে স্কুলে হয়েছিল তাদের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। সেই স্কুল থেকে বিদায় নিতে নয় বরং স্কুলকেই হাত নাড়িয়ে বিদায় দিতে হয়েছে তাদের। এ আবেগেই আপ্লুত হয়ে পড়েছিল শিশুরা।
ঘটনাটি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর চরমোন্তাজ ইউনিয়নের। ৪ বছর আগে এখানে স্লুইসের খালে জলেভাসা মান্তা সম্প্রদায় শিশুদের জন্য প্রথমবারের মতো চালু হয়েছিল প্রাক-প্রাথমিক ‘ভাসমান বোট স্কুল’। বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে শুরু হওয়া প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় শুক্রবার বেলা সাড়ে ১০টায় একতলা লঞ্চ আকৃতির স্কুলটি সংস্থার হেফাজতে বরগুনায় নিয়ে যাওয়া হয়। চোখের সামনে থেকে স্কুলটি নিয়ে যাওয়ার দুঃখ ধরে রাখতে পারেনি শিশুরা। তাই নিয়ে যাওয়ার সময় বুড়াগৌরাঙ্গ নদী তীরে এসে অঝোরে কাঁদছিল শিশু রাজিয়া, মিম, ছখিনা, সায়েম, শাহিদাসহ প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী। তাদেরই কয়েকজন অশ্রুসিক্ত চোখে বলে, আমরা কলম ধরতে শিখছি এ স্কুলে। আমাদের সেই স্কুলে আর যাওয়া হবে না। অভিভাবকরা জানান, নদী ও ডাঙায় মিলে ৩০০ মান্তা শিশু রয়েছে। ভাসমান স্কুলের কারণে ধীরে ধীরে তারা স্কুলগামী হচ্ছিল। কিন্তু স্কুলটি বন্ধ হওয়ায় তাদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মান্তা সম্প্রদায় যুগের পর যুগ শিক্ষার আলো বঞ্চিত ছিল। চরমোন্তাজ ইউনিয়নের স্লুইস গেটের খালে ১১০টি পরিবার নৌকায় নদ-নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছিল। তাদের কাছে শিক্ষা ছিল শুধুই বিলাসিতা। কিন্তু তাদের শিশুদের জীবনে লাগে শিক্ষার ছোঁয়া, হইহুল্লোড় করে স্কুলে যাওয়ার আনন্দ। ২০১৯ সালের জুনে বেসরকারি সংস্থা জাগোনারীর উদ্যোগে মুসলিম চ্যারিটির অর্থায়নে মান্তা শিশুদের জন্য এ ভাসমান বোট স্কুল স্থাপন করা হয়েছিল। আর এ সুযোগ পেয়ে প্রাকের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক শিশু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়েও লেখাপড়া করছে। এতে তাদের জীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। দূর হতে থাকে ডাঙার মানুষের সঙ্গে বৈষম্যও।
ভাসমান বোট স্কুলের শিক্ষক আইয়ুব খান বলেন, ডাঙার মানুষের সঙ্গে বৈষম্য থাকায় মান্তা শিশুরা আগে ডাঙার স্কুলে পড়ালেখা করতে যেত না। কিন্তু ভাসমান স্কুল চালু হওয়ার পর বাবা-মা নদীতে মাছ ধরতে গেলেও বই-খাতা নিয়ে শিশুদের স্কুলে পাঠানো হতো। তিনি আরও বলেন, সুবিধাবঞ্চিত এসব মানুষ পেতে শুরু করে সরকারি সুবিধাও। ৫৯ পরিবারকে দেওয়া হয় মুজিববর্ষের ঘর। ফলে ডাঙায় বসবাসের সুযোগ পান তারা। কিন্তু এখনো প্রায় অর্ধশত পরিবার নৌকাতেই বসবাস করছে। তাদের শিশুদের জন্য ভাসমান স্কুলটি ছিল কার্যকর। কিন্তু স্কুলটি বন্ধ হওয়ায় এখন শিক্ষাজীবন থেকে অনেক শিশু ঝরে পড়তে পারে।
কর্তৃপক্ষ জানান, মান্তা সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন ডাঙায় উঠেছেন। তাদের মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে শিশুদের স্কুলগামী করার অভ্যাস করা হয়েছে। তাই প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়িয়ে স্কুলটির কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। জাগোনারীর পরিচালক (যোগাযোগ) ডিউক ইবনে আমিন বলেন, ভাসমান বোট স্কুল প্রকল্প শেষ হলেও নদীপাড়েই জাগোনারীর নির্মিত মসজিদ কাম কমিউনিটি সেন্টার ভবনের দ্বিতীয়তলায় শিশুদের লেখাপড়ার কার্যক্রম চলবে। অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। খুব শিগগিরই সেখানে আমরা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করব।
উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা বায়েজিদ ইসলাম বলেন, মান্তা শিশুদের শিক্ষার জন্য ভাসমান স্কুলটি সহায়ক ভূমিকা পালন করছিল। ওইসব শিশুর জন্য সরকারি স্কুল নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। মান্তা সম্প্রদায়কে দেওয়া মুজিববর্ষের ঘরসংলগ্ন এলাকায় স্কুলটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত রয়েছে।